রায় নিয়ে প্রোপাগান্ডা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আহা কী চমৎকার যুক্তি! আজ যদি হিটলারের প্রোপাগান্ডা-মিনিস্টার গোয়েবলস বেঁচে থাকতেন, তাহলে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের (কলামিস্টরা কি বুদ্ধিজীবী? ইউরোপে তারা বুদ্ধিজীবী বলে স্বীকৃত নন) একাংশের মধ্যে যে নতুন গোয়েবলসদের আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের যুক্তিতর্ক শুনলে তিনি লজ্জায় মুষড়ে পড়তেন। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো না বলার যে অদ্ভুত দক্ষতা ও তর্কশক্তি তারা দেখাচ্ছেন, তা দেখে গোয়েবলস নিশ্চয়ই মনে মনে স্বীকার করতেন- নাহ্, তিনি এদের তুলনায় কিছুই ছিলেন না। গত আট ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলার রায়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানসহ দণ্ডিত হতেই এই বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টরা রায়টি সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার নামে যেসব কথা বলছেন, তাকে আহাম্মকি যুক্তি ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। তাদের প্রকাশ্যে একথা বলার সাহস নেই যে, এটা মিথ্যা মামলা এবং রায়টাও আওয়ামী সরকারের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু তাদের অনেকে আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছেন, দেশে এত বড় বড় দুর্নীতি চলছে, অনেক আওয়ামী লীগারও তাতে জড়িত, তাদের বিচার না করে খালেদা জিয়ার বিচার করা কেন? এর পেছনে সরকারের অভিসন্ধি রয়েছে সন্দেহ করা যায়। বিএনপিরও এটাই প্রোপাগান্ডা। তারা সরাসরি বলছেন এটা মিথ্যা মামলা। খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। আর দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট সে কথা না বলে প্রচ্ছন্নভাবে দেশের মানুষের মনে এই সন্দেহের বীজ বপন করছেন যে, দেশে এত বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটতে থাকলেও তার বিচার না করে খালেদা জিয়ার বিচার কেন? এর পেছনে সরকারের নিশ্চয়ই হাত রয়েছে। বিএনপি নেতারাও যে বলছেন তাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে এটা ছিল মিথ্যা মামলা, তা দেশের মানুষকে তারা বিশ্বাস করাতে পারেননি। কারণ, খালেদা ও তারেকের বিরুদ্ধে এই মামলা বর্তমান আওয়ামী লীগ করেনি। করেছে তাদের পূর্ববর্তী সেনাপ্রভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারপর নয় বছর ধরে মামলাটি চলেছে এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রায় হয়েছে। এই রায়ে আওয়ামী লীগ নেতারা খুশি হতে পারেন, কিন্তু রায় প্রদানের ব্যাপারে সরকার বিচারকদের প্রভাবিত করেছেন তা ৬৭২ পৃষ্ঠার রায়টি ভালোভাবে পর্যালোচনা না করে বলাটা উদ্দেশ্যমূলক।
বিএনপি নেতারা তাদের দলীয় স্বার্থে এ প্রোপাগান্ডা ছড়াতে পারেন। কিন্তু যে বুদ্ধিজীবীরা অহরহ নিজেদের নিরপেক্ষ বলে প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত, তারা মামলার রায়টিতে একবার চোখ না বুলিয়ে, তার ত্রুটি উদ্ঘাটন না করে প্রচ্ছন্নভাবে বিএনপি নেতাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাবেন, তা আশা করা যায় না। বিএনপির প্রোপাগান্ডা অবশ্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করেনি। করলে খালেদা জিয়াকে আদালত থেকে জেলে পাঠানোর দিনই মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসত। তারা আসেনি। বিএনপির জনবল বলতেই জামায়াত। জামায়াত সবসময় বিএনপির মিছিলে জনসংখ্যা বাড়ায়। এবারও তাদের সাহায্যে বিএনপি ঢাকায় এবং অন্যান্য শহরে ছোট-বড় মিছিল-মিটিং করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সরকারের সঙ্গে কোনো শোডাউনে যেতে তারা সাহসী নয়। দলের নেতারা অনবরত বলছেন, নেত্রী বলে গেছেন আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাতে। এ নেতারা জানেন, আগের মতো জনসমর্থনহীন আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস চালাতে গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের সম্পর্কে যেটুকু সহানুভূতি আছে, তাও থাকবে না। ৮ ফেব্রুয়ারির রায় সম্পর্কে বিএনপি যে সন্দেহটা মানুষের মনে জাগাতে পারেনি, সেটা জাগানোর দায়িত্ব নিয়েছেন ঢাকার একটি ‘নিরপেক্ষ বাংলা দৈনিক’। এ দৈনিকের দুটি চেহারা। দেশের অবস্থা যখন স্বাভাবিক, তখন এ পত্রিকা যথার্থই নিরপেক্ষ। কিন্তু এ অবস্থায় কোনো তারতম্য ঘটলেই তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ছোট-বড় ত্রুটি বড় করে তুলে ধরে। খুঁত না থাকলে তা আবিষ্কার করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলোর তুলনা টানার নামে ব্যর্থতাগুলো বড় করে দেখায়। বিএনপি যে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সফল হয় না, প্রচ্ছন্নভাবে সেগুলো সফল করার দায়িত্ব নেয় পত্রিকাটি। ৮ ফেব্রুয়ারির রায় সম্পর্কে পত্রিকাটি একই কৌশল গ্রহণ করেছে। নিজেকে নিরপেক্ষ-নির্ভীক বলে পরিচয় দিলেও সরাসরি এ রায়ের সমালোচনা করার সাহস তার নেই। সে ‘পরের মুখে ঝাল খাওয়ার’ নীতি গ্রহণ করেছে। এ রায় নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের নামে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য যেসব বুদ্ধিজীবী কলম উঁচিয়ে বসে থাকেন, বেছে বেছে তাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে ছেপেছেন। তাদের মধ্যে দু’একজনের যে নিরপেক্ষ কণ্ঠ নেই, তা নয়। কিন্তু বাজারি হৈচৈয়ে তাদের কণ্ঠও হারিয়ে গেছে। বিএনপি নেতারা রাতদিন চিৎকার করে মানুষের মনে যে সন্দেহটা জাগাতে পারেনি, এ ‘নিরপেক্ষ’ পত্রিকা সমাজের কিছু অংশের মধ্যে এ সন্দেহটা জাগাতে সফল হয়েছে। ঢাকায় আমার যে সাংবাদিক বন্ধু দু’দিন আগেও খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের দুর্নীতি ও অপশাসন সম্পর্কে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার পর ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকে এ সম্পর্কে তথাকথিত সুধীজনের প্রতিক্রিয়া পাঠের পর আমাকে বলেছেন, ‘কথাটাতো সত্যি’, দেশে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে, ব্যাংকে লুটপাট চলছে, যার কোনো কোনোটার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো হোমরা-চোমরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে। তাদের না ধরে কেবল খালেদা জিয়াকে ধরা কেন? এটা কি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা নয়? সুধীজনরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তো ঠিকই কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য কী, তা আমি জানি না। তারা যদি মনে করেন, খালেদা জিয়া জেলে বন্দি থাকলে এবং বিএনপি দেশে এ ব্যাপারে কোনো বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেই সমস্যা চলে যাবে তাহলে ভুল করবেন। বিএনপি সংগঠন হিসেবে দুর্বল হলেও তার প্রোপাগান্ডা শক্তিশালী। তাদের সহায়কশক্তি হিসেবে আছে নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশধারী একটি মিডিয়া গ্রুপ। আছেন যাদের কথা গোড়াতেই বলেছি সেই একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের কিছু শিক্ষকও আছেন তাদের মধ্যে। তারা যদি প্রচ্ছন্নভাবে মানুষের মনে এ সন্দেহটাও জাগ্রত করতে পারেন যে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলা এক-এগারোর সরকার করলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তা দীর্ঘকাল ঝুলিয়ে রেখে এখন নির্বাচনের বছরে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়েছেন এবং দেশে এত বড় বড় দুর্নীতি ও ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও খালেদা জিয়াকেই শুধু বিচার ও দণ্ড দেয়ার জন্য টার্গেট করা হয়েছে, তাহলে আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়বে। বিএনপিকে আন্দোলন করতে হবে না, তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের এ প্রচারণাই বিএনপির অনুকূলে কাজ করবে। আওয়ামী লীগকে তাই আত্মসন্তোষে না ভুগে এ মামলা সম্পর্কে জনগণের একাংশের মন থেকে সব সন্দেহ দূর করার জন্য আন্তরিকতা ও সততা নিয়ে তাদের কাছে নিজেদের অবস্থা তুলে ধরতে হবে। পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে বিএনপির আন্দোলন ঠেকানো যাবে, মানুষের মনের সন্দেহ ও বিভ্রান্তি দূর করা যাবে না। ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুকে এ ব্যাপারে আমার কথা খুলে বলেছি। তাকে জানিয়েছি, আওয়ামী লীগের আমলেও বড় বড় দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হয়েছে। সরকার কিছুই করেনি তা নয়।
হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের অভিযুক্তরা এখন জেলে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামিরা র‌্যাবের অফিসার ও মন্ত্রীর জামাই হওয়া সত্ত্বেও রেহাই পায়নি। আওয়ামী লীগ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনের জন্য চেষ্টা করছে। সবসময় সফল হয়নি। বিএনপির মতো বড় বড় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও তারেক-কোকোর দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেনি। তারপরও আওয়ামী লীগের যেসব দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়াল এখনও বিচারের আওতার বাইরে রয়েছেন, তাদের বিচার ও দণ্ডদানের জন্য দাবি তোলা অবশ্যই দরকার। কিন্তু তার সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিচার ও দণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেত্রী। তার এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে দেশে স্বচ্ছ রাজনীতির স্বার্থে অবশ্যই তার ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর দশটা দুর্নীতি যত গুরুতর হোক, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা চলবে না, শুধু দেখতে হবে ন্যায়বিচারটা হয়েছে কিনা। ন্যায়বিচার না হয়ে থাকলে তখন অন্য কথা। একথা বলা চলবে না যে, আর দশটা দুর্নীতির মামলা না হলে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিচার করা যাবে না। এক মনীষী বলেছেন, ‘একটি অন্যায় দিয়ে আরেকটি অন্যায় ঢাকা দেয়া যায় না। একটি অন্যায়ের বিচার হয়নি বলে আরেকটি অন্যায়ের বিচার ঝুলিয়ে রাখা আরও বড় অন্যায়।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপি এবং বিএনপি-সমর্থকরা একই ধুয়া তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কেন বিচার হচ্ছে না একথা তুলতেই বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেছিলেন, ‘দেশে তো শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করা হয়নি, আরও বহু হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সেগুলোর আগে বিচার হোক, তারপর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা ভাবা যাবে।’ একদিকে এ বুলি আউড়িয়ে অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের আওতা থেকে ইনডেমনিটি দিয়ে উচ্চ কূটনৈতিক পদে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল। বিএনপি নিজেদের ইতিহাস নিজেরা ভুলেছেন এবং দেশের মানুষকেও ভোলাতে চাইছেন এবং তাতে সহযোগী হয়েছেন দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এবং একটি তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া গ্রুপ। তারা ৮ ফেব্রুয়ারির রায় নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছেন। এ নির্বাচনী বছরে জনসাধারণের একাংশের মনের এ সন্দেহটা দূর করতে হবে যে, এ রায়ের পেছনে সরকারের কোনো কারচুপি নেই এবং আইনকে তার নিজস্ব পথে চলতে দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.