‘১২ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলে না’ by মুসা বিন মোহাম্মদ

কুমিল্লার মৌটুপী ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক মজিবুল ইসলাম। মাস শেষে সরকারের পক্ষ থেকে বেতন পান ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। সাত সদস্যের পরিবারের বড় ছেলে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা। আরেক ছেলে রাজধানীর পল্টনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এ মাসের ১৭ তারিখে মজিবুল ইসলাম তার মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের অনশনে অংশ নিয়েছেন। অনশনস্থলে গতকাল এই সহকারী শিক্ষক মানবজমিনকে বলেন, আমি যে বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চলে না।
সরকারি অনেক মাদরাসার শিক্ষক আছেন যারা আমাদের থেকে বেশি বেতন পান। এই বেতন বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে আন্দোলন করছি।
মজিবুলের চেয়ে বেশি বেতন পেয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ঝিনাইদহের শিক্ষক এবিএম নেছারউদ্দিনের। ১৬ হাজার টাকা স্কেলে মাস শেষে ১৬৫৪০ টাকা বেতন পান ঝিনাইদহের আলমপুর মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের এই সহকারী শিক্ষক। দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ তার ৬ সদস্যের পরিবার। বড় ছেলে ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি বেতন ও জমিজমা চাষ করেও সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানান নেছারউদ্দিন। তার কষ্ট হলো- একই পদে থেকে জাতীয়করণের শিক্ষকরা মাস শেষে বেতন-ভাতা মিলে পাচ্ছেন আমাদের দ্বিগুণ। জাতীয়করণ হলে তাদের সমান তার বেতন হতো বলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ফুটপাথে শুয়ে অনশনরত অবস্থায় দুঃখ প্রকাশ করেন শিক্ষক নেছারউদ্দিন। গত ১০ই জানুয়ারি থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থানের পর ১৫ তারিখ থেকে অনশনে আছেন এই শিক্ষক। অনশনের ১১তম দিনে অনশনস্থলে মানবজমিনকে তিনি বলেন, আগে বেতন একটু কম ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর এক দফা বেতন বাড়িয়েছে। আমার বেতন আরো বাড়ার কথা ছিল কোনো কারণে তা হয়নি। এবার সবার বেতন এক অনুপাতে দেয়ার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। ঝিনাইদহের এই শিক্ষকের চেয়ে পরিবার চালাতে গিয়ে বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে ময়মনসিংহের আনোয়ার হোসেনকে। যদি তার বেতন স্কেল তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে গোন্দাজ বিদ্যালয় থেকে তিন দিনের ধর্মঘটের শেষ দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার লাগাতার অনশনে অংশ নিয়েছেন আনোয়ার হোসেন। এই শিক্ষক মানবজমিনকে বলেন, আমার ৫ সদস্যের পরিবার। ২২ হাজার টাকা স্কেলে মাস শেষে বেতন পাই ২২৫০০ টাকা। তবুও আমার সংসার চলে না। ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ দিতে হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে বোনাস, ভাতা পেলে সবাইকে নিয়ে আরেকটু ভালোভাবে চলা যাবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
রাজধানীর প্রেস ক্লাবের মূল ফটকের পূর্ব পাশে বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের ব্যানারে আন্দোলনকারী এই শিক্ষকরা। পাশাপাশি প্রেস ক্লাবের পশ্চিম পাশের ফুটপাথে বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংগঠনের ব্যানারে ২১শে জানুয়ারি অবস্থানের দুইদিন পর থেকে অনশন কর্মসূচি পালন করছেন আরেক দল শিক্ষক। এই শিক্ষকরা সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো চাকরি করলেও সরকারের কাছ থেকে বেতন পান না এক টাকাও। তাদের মধ্যে একজন হলেন ভোলার চরফ্যাশনের আলীগঞ্জ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুব আলম। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও সরকারের কাছ থেকে কোনো বেতন- ভাতা কিছুই পান না। ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করা অবস্থায় অনশন করছেন মাহবুব আলম। এই প্রধান শিক্ষক বলেন, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তো সরকারের কাছ থেকে কিছু হলেও পায়। আমরা দিনের পর দিন বিনা বেতনে চাকরি করছি। এর আগে একই জায়গায় নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরা সরকারের পক্ষ থেকে বেতনের দাবিতে লাগাতার আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। লাগাতার আন্দোলনরত এসব শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের পক্ষ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত হওয়ায় শিক্ষকদের কঠোর আন্দোলনের মুখে দাবি পূরণের ঘোষণা দেয় সরকার। এর পরপরই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলন শুরু করেন এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো সাড়া না আসায় অনশনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে অনশনের পর ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এ পর্যন্ত অনশনে ১২৩ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন লিয়াজোঁ ফোরামের শিক্ষক নেতারা। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি-সংসদে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষকদের বেতনের বিষয়ে ইঙ্গিত পেলেও তাদের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। শিক্ষাখাতের বৈষম্য দূরীকরণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এ দাবি শিগগিরই সরকার পূরণ করবে বলে আশা করছেন আন্দোলনকারী এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা।

No comments

Powered by Blogger.