সৌদি আরবে বিনোদন যুগের সূচনা by বিল ল'

গত বছরের অক্টোবরে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অনুষ্ঠিত প্রথম ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ উদ্যোগ নামক সম্মেলনে দ্যুতি ছড়ানো আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন হলিউডের সবচেয়ে বড় ট্যালেন্ট এজেন্সিগুলোর একটির সিইও অ্যারি এমানুয়েল। কোনো সন্দেহ নেই, পাঁচ তারকা রিজ কার্লটন হোটেলের বিলাসবহুল বলরুমে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মূল বক্তব্য তিনি উৎসুকভাবে শুনেছেন। কারণ, যুবরাজ সেখানে বিদেশি কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য দেয়া সুযোগ-সুবিধার বিস্তারিত তুলে ধরেছিলেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘনিষ্ঠ, শিকাগোর মেয়র র‌্যাহম এমানুয়েলের ভাই অ্যারির একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল ওই সম্মেলনে। সেখানে তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন-২০৩০-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং সৌদি আরবে একটি অর্থনৈতিক বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিনোদন ও সংস্কৃতি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে বলে উল্লেখ করেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল ‘আমি মনে করি আপনারা লাইভ এন্টারটেইনমেন্ট ও মিউজিক দেখবেন, খাবার উৎসব, ফ্যাশন, আর্ট শো’ ইত্যাদিতে যাবেন এবং তাহলে দেখবেন ভিশন-২০৩০-এর সঙ্গে এগুলোর দীর্ঘমেয়াদি একটি সম্পর্ক আছে, বিশেষত তারা যা হতে চায় তার সঙ্গে।’ নিজের কোম্পানি উইলিয়াম মরিস এন্ডেভারের জন্য এমানুয়েল অ্যারি যা চেয়েছিলেন, তা হল সৌদি আরবের সম্ভাবনাময় এন্টারটেইনমেন্ট শিল্পে বড় ভূমিকা রাখবে কোম্পানিটি। সর্বোপরি, ইসলামের কট্টর ওয়াহ্হাবি ব্যাখ্যার আওতায় কয়েক দশক ধরে দেশটি এন্টারটেইনমেন্ট-বিনোদনত্যাগী হয়ে পড়েছে। সেখানে কোনো সিনেমা ছিল না, থিয়েটার ছিল না; ছিল না কোনো জনপ্রিয় লাইভ মিউজিক কনসার্ট। কিন্তু এখন মোহাম্মদ বিন সালমান হাল ধরার পর সৌদি আরবে তার মতে ‘মডারেট ইসলাম’ ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছেন। ফলে ভিত্তি গড়তে যাওয়া বিনোদন শিল্প এখন ভালো ও মনোরম একটি অবস্থানে পৌঁছার হাতছানি দিচ্ছে। দেশটিতে এ শিল্পের বিশাল বাজার সম্ভাবনা রয়েছে- কারণ, সৌদি আরবের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বয়সই ৩০-এর নিচে। যেহেতু ভিশন-২০৩০ গ্রহণ করা হয়েছে- ‘আমরা যথেষ্ট সচেতন যে, বর্তমানে থাকা সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক সুবিধা আমাদের নাগরিক ও বসবাসকারীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে না, এমনকি সেগুলো আমাদের উন্নতির দিকে যাওয়া অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও নয়’।
অন্যদিকে মোহাম্মদ বিন সালমানও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন যে, তিনি যদি নিজেকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শীর্ষে রাখতে পারেন, তবে এখান থেকে প্রচুর আয় বের করা যেতে পারে। ভিশন-২০৩০ বলছে, বিনোদন খাত ২২ হাজার মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করবে। আরও প্রলুব্ধ হওয়ার মতো বিষয় হল, এন্টারটেইনমেন্ট ও হলিডে রিসোর্টগুলোয় যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তাতে পর্যটন খাতকে উন্নত করা হচ্ছে, যাতে করে এটি সৌদি আরবে বার্ষিক ৫ কোটি পর্যটক টানতে পারে; এ সংখ্যা বর্তমানে হজে আসে- এমন পর্যটকের সংখ্যা বাদ দিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। নিজের ক্ষমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যুবরাজ কত বেশি বেপরোয়া, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে অসাধারণ বিবেচিত ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্মেলন রিটজ কার্লটন হোটেলে শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরেই। ৪ নভেম্বর হোটেলটির অতিথিদের চলে যেতে বলার পর বিলাসবহুল হোটেলটি ২০০-এর বেশি ব্যবসায়ী ও রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যের জন্য কারাগারে পরিণত করা হয়। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের তকমা দিয়ে তেমনটি করা হয়েছিল। দমন-পাকড়াও অভিযানটি পরিচালনা করা হয় দুর্নীতিবিরোধী কমিটির আদেশে, যার প্রধান মোহাম্মদ বিন সালমান। গ্রেফতার শুরু হওয়ার পর রাজকীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে ওই কমিটি ঘোষণা করা হয়। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যাদের আটক করা হয়েছিল তার মধ্যে বিশ্বের অন্যতম ধনী যুবরাজ আল-ওয়ালিদ বিন তালাল, সালেহ আবদুল্লাহ কামাল এবং ওয়ালিদ আল-ইবরাহিমও ছিলেন। বড় ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগের পাশাপাশি এ তিনজনের ক্ষেত্রে একটি বিষয় কমন- তা হল তারা সবাই বড় ধরনের এন্টারটেইনমেন্ট ও মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান বা প্রধান উদ্যোক্তা। বিন তালালের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি হল রোতানা মিডিয়া সার্ভিসেস- যা রেডিও এবং টিভি স্টেশন, ম্যাগাজিন, মিথস্ক্রিয় মিডিয়া এবং মুভি ও মিউজিক ভিডিও সরবরাহের বহুবিদ কাজ করে থাকে। কামালের মিডিয়া হল- এআরটি, আরব রেডিও এবং টিভি স্টেশন, যার আওতায় আছে ওএসএনসহ অনেক চ্যানেল। এ ছাড়া তার কোম্পানি মুভি, মিউজিক ও স্পোর্টসের মতো পারিবারিক এন্টারটেইনমেন্ট সরবরাহ করে থাকে। আল-ইবরাহিম নিয়ন্ত্রণ করেন এমবিসি- মিডলইস্ট ব্রডকাস্টিং সেন্টার। এ কোম্পানিটি চিলড্রেনস নেটওয়ার্ক, ২৪ ঘণ্টা নিউজ এবং বিশেষায়িত চ্যানেল ‘দ্য নিউ আরব উইমেন’সহ অনেক চ্যানেল পরিচালনা করে থাকে। কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’র মুখোমুখি করা হবে। প্রকৃতপক্ষে এ সংক্রান্ত যা কিছু সৌদি আরবে ঘটেছে, তা ছিল একটি কম্পন। পরে আটককৃতদের কেবল বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয় এবং অনেকে এ পদ্ধতিতে মুক্তি নেয়। অন্যথায় তাদের ব্যবসা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তৎকালীন সৌদি আরব ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান যুবরাজ মিতেব ও সাবেক বাদশাহ আবদুল্লাহর এক ছেলেকে ১০০ কোটি ডলার পরিশোধের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয় বলে খবর বেরিয়েছে। আল-ওয়ালিদ বিল তালাল তার ব্যবসা ছাড়তে রাজি হননি, ফলে তিনি আটক রয়ে গেছেন। ধারণা করা হয়, কামাল ও আল-ইবরাহিমকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। সৌদি রাষ্ট্রপদ্ধতির অস্পষ্টতার কারণে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত স্বার্থ কোথায় শেষ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ শুরু, তা চিহ্নিত করা অসম্ভব। তবে যে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট, তা হল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (পিআইএফ) প্রধান, অল-ইনকম্পাসিং কাউন্সিল ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ক্রাউন প্রিন্স, প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী ও দুর্নীতিবিরোধী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সব অর্থনৈতিক বিষয় বিন সালমানের হাত দিয়েই পাস হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে পিআইএফ এন্টারটেইনমেন্ট সেক্টরে ২৭০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়। বর্তমানে এমানুয়েলের কোম্পানি পিআইএফের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে, যেখানে কোম্পানির অংশীদারিত্বের জন্য ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হবে। এমানুয়েল অ্যারি চাচ্ছেন দৈবাৎ পাওয়া এ অর্থ দিয়ে কোম্পানিকে আরও বৈচিত্র্যময় করতে, যাতে এরই মধ্যে কেনা আইএমজি বা আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপের স্পোর্টস গাড়ি, বিপুল স্পোর্টস সরঞ্জাম, ফ্যাশন ও লাইভ ইভেন্ট তৈরি করা যায়। এ ছাড়া তিনি সৌদি আরবের সমৃদ্ধ অনুন্মোচিত অঞ্চলের দিকে মনোযোগ দিতে চান। বিনিয়োগ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ অন্য মানুষের সঙ্গে বাইরে যেতে পছন্দ করে’। ‘তারা পছন্দ করে সামাজিক বিভিন্ন বিষয়, তাই মুভি ও কনসার্ট হতে পারে বড় ভূমিকা পালনকারী আর স্পোর্টস হচ্ছে ভালো অনুঘটক।’ এসব কিন্তু ঢেকে রাখা হয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমানের নিয়ন্ত্রণাধীন পিআইএফ ফান্ডের সঙ্গে সংযুক্তি অবশ্যই স্বর্গে বিয়ের মতো দেখা যায়; কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের আগে এমানুয়েল অ্যারি হয়তো হোটেল রিটজ কার্লটনে গত বছর যা ঘটেছে, তা বিবেচনায় নিতে পারেন। সন্দেহ নেই, আটককৃতরা দুর্নীতি চর্চায় জড়িত ছিলেন; কিন্তু এটিই হচ্ছে সৌদি আরবের ব্যবসায়ী সমাজ ও শাসক পরিবারের নিত্যদিনের ঘটনা। একটি সূত্র সম্প্রতি বাঁকা হাসি হেসে আমাকে বলেছে, ‘দেশের সবাই জানে গ্রেফতার করা হয়েছে বাছাইকৃতদের’। যা কিছুই ঘটেছে, আটককৃতদের মানবাধিকার, মুক্ত ও স্বচ্ছ শুনানি পাওয়ার অধিকার পদদলিত করা হয়েছে। তাদের ব্যবসা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পদ আটকে রাখা হয়েছে। তারা দেশ ছেড়ে যেতে অক্ষম। এমানুয়েল পুরোদস্তুর নিষ্ঠুর ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত; কিন্তু তিনি সম্ভবত নিজের ভালো মিল বা আরও বেশি খুঁজে পেতে পারেন মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যে।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ: সাইফুল ইসলম
বিল ল’: মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ও বিবিসির সাবেক সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.