টেপ থেকে

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে গত রোববার আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিধি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষা পরিদর্শকদের ল্যাপটপ প্রদান অনুষ্ঠানে মন্ত্রী প্রায় ৫০ মিনিট বক্তব্য দেন। তার পুরো বক্তব্য অধিদপ্তরের ফেসবুক পেজে  সরাসরি প্রচার করা হয়। সেখান থেকে নেয়া ভিডিও রেকর্ড শ্রুতিলিখন করে ঘুষ, দুর্নীতি বিষয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য হুবহু নিচে তুলে ধরা হলো।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ডিআইএ কর্মকর্তারা এগুলো...নানা প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আপনাদের দক্ষতাকে কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। মন-মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই কাজটা করবেন।
তবে এটা ঠিক আমি অতীতটাকে আপনাদের গাড়ে চাপাতে চাচ্ছি না। আমাদের অভিজ্ঞতা ও অতীতকে স্মরণ করে কাজ করতে হবে। কারণ, ডিআইএ বাস্তব কাজের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার কাজ যদি সঠিকমতো হয়, তবেই সব জায়গায় ঠিকঠাক মতো চলবে।
আগে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি) নাম ছিল ফ্যাসেলিটিজ ডিপার্টমেন্ট। সবাই ঠাট্টা করে বলতো ফ্যাসেলিটিজ মানে নিজেদের ফ্যাসেলেটিজ করা। মানুষের কল্যাণের জন্য না। এমনটাই ধরে নেয়া হতো। ওইখানে এমন একটা অবস্থা ছিল যারা যোগ্য দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে, তাদের নিয়োগ দেয়া হতো না। চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব ছাড়া কেউ এখানে ওপরে পদে উঠতে পারতো না। চিফ ইঞ্জিনিয়ারসহ ওপরের পদগুলোতে আসতো চুক্তিভিত্তিতে। তাদের এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হতো। এই এক বছরে তিনি এ প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের মতো গ্রহণ করবেন? করবেন না। আর ওই লোকগুলো কোথায় থেকে আসতো। এখানে আসার একটা ম্যাকানিজম ছিল। ২০০৯ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর দেখলাম এখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চলে আসছে। আমার সঙ্গে কথা না বলেই চিপ ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেয়া হতো। আমি এটার খোঁজ নিয়ে দেখলাম এখানে বিরাট অংকে টাকার বিনিময়ে আসেন। এটা শোনার পর আমার মাথা ঘুরে গেল। আমি না জানার কারণ হলো এ কাজটা ওপরে সারা হয়ে যেতো। এজন্য ইইডির সবাই হতাশ হয়ে পড়েন। বর্তমান চিফ ইঞ্জিনিয়ার দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা কর্মদক্ষতার কারণে গত বছর এডিবি বাস্তবায়নের অগ্রগতি ভালো ছিল। আমরা তাকে এবং তার ডিপার্টমেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।
মন্ত্রী বলেন, আমি আসার পর সরকারের নানা পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে সব দপ্তরকে নিয়ে আলাদা আলাদা বসলাম। আমি সব জায়গায় এমনকি মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। অপচয় বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি থাকবে। কিন্তু ইইডির ব্যাপারে আমি বলছি, দয়া করে আপনারা ভালো কাজ করবেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা ঘুষ খাবেন, কিন্তু সহনশীল হয়ে খাবেন। কারণ, আমার ওই সাহসই নাই বলা যে আপনারা ঘুষ খাইয়েন না...। তারপর এখানে অনেক চেষ্টা নিছি। পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। চিফ ইঞ্জিনিয়ার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বাদ দিতে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে প্রমার্জনা করিয়ে আনতে হয়েছে। এরপর সৎ লোক খুঁজে বের করতে হবে জানাই। কাজ না জানলেও চলবে কিন্তু সৎ হতে হবে।
এখন খুবই ভাল চলছে ইইডি। মাঝখানে সরকারের কাছ থেকে প্রস্তাব আসছে ইইডিকে অন্য আরেকটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়ার। আমি বলেছি, আপনারা ওপরে গিয়ে বলেন, আমরা কারও সঙ্গে যুক্ত হবো না কারও যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে থাকলে তারা যেন হয়। এখন সেই সংস্থাটি ঠিক আছে, দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য অনলাইনে টেন্ডার দেয়া হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো টেন্ডার হয় না। এজন্য স্বার্থান্বেষী একটি মহল তারা মামলা-মোকাদ্দমা করে নানা চাপ দেয়া শুরু করলো।
এখানে (ডিআইএ) যখন বৈঠক করছিলাম তখনকার যা চিত্র, যা অবস্থা ছিল এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল ইইডির মতো। স্কুলে খাম তৈরি করা থাকতো, আপনার কাজ হলো, আপনি গেলেন, খাম আপনার হাতে ধরিয়ে দিবে, আর আপনি খেয়ে-দেয়ে খাম নিয়ে চলে আসবেন। এসে রিপোর্ট দিবেন ঠিক আছে। এ ছিল মানুষের কাছে আমাদের ইমেজ। তখন ওই পদ্ধতির মাঝে আমরা কড়াকড়ি করলাম। এটা হবে না, আমরা খোঁজখবর রাখবো, চেষ্টা করবো। তারপর আবার যখন তারা গেল, অনেক স্কুলের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, কমিটির চেয়ারম্যান আমাকে ফোন করে বললো, এবার ডিআইএ লোকজন আসছিল, কিন্তু অন্যবারের মতো না। এবার তারা খুব ভালো করছে। কেউ কেউ এমন স্বচ্ছ হয়ে গেছে, তারা এক কাপ চাও খেতে চায় না। তারা বললো, আমরা আপনাদের টাকায় এক খাপ চাও খাবো না। আমি বলছি, এত কড়াকড়ি হইয়েন না। কারও বাড়িতে গেলে কেউ এক কাপ চা খাওয়াতে পারে। এটা নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। এর বিনিময়ে কিছু নিয়ে আসবেন কি না বা সে কিছু চায় কি না সেটা বুঝে নিবেন। আমরা মাছও খেতে পারি মাংসও খেতে পারি। কিন্তু আমার যদি এর মধ্যে স্বার্থ থাকে তাহলে চা খাওয়ার দরকার নেই। আবার এমন ফোনও আসছে, আপনার তো কোনো পরিবর্তন হয়নি। বড় বড় কথা বলেন মন্ত্রীরা। আপনার লোক তো এখানে আসছিল সে তো খাম নিয়েই গেল। পেয়ার ইন্সপেকশনসহ নানা উদ্যোগের মাঝে কিছু দিন আগে একজন কর্মকর্তার পেছনে তথ্য সংগ্রহ করলাম। তিনি ওখানে গিয়ে ৫টা স্কুলের সঙ্গে চুক্তি করলেন সব কর্মচারী পিয়ন থেকে প্রধান শিক্ষক পর্যন্ত এক মাসের বেতন তাকে দিতে হবে। না হলে খারাপ হবে। এ কথাটা আমাকে বলেছে। তার সম্পর্কে সব তথ্য পাওয়ার পর প্রধান শিক্ষক আর রাজি হয় না। টাকা সব নিয়ে যাও তবু আমরা ঝামেলায় পড়তে চাই না। বাঘে খাইলে আটারো ঘা, আর ...। এটার দরকার নাই। বহুত কষ্টে তাকে ধরে নিয়ে আসলাম এখানে, এখানে ধরতে পারলাম না। কত সতর্ক। তারপরও যদি ধরি থানাওয়ালা ঘুষ খেয়ে সাইজ। আরেকটু যদি এগিয়ে যাই কোর্টে। সেখানেও উকিল-মোক্তার দিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাবে। আমাদের কোনো ইন্টারেস্ট নাই। তারপর আমি দুদক দিয়ে ধরাইলাম। এতো কিছুর পরও আমাদের মধ্যে কী অবস্থা। আর কত কিছু রয়ে গেছে। এখন এক মাসের বেতন মানে দ্বিগুন হয়ে গেছে। সবাই মিলে এক মাসের বেতন দিতে হবে। সেটা ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। তাকে ধরার সময় তার পকেটে পাওয়া গেছে আড়াই লাখ টাকা। ওদের কাছ থেকে নিচ্ছিল আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা। ওই টাকা লেনদেন করতে গিয়েই আমরা তাকে ধরলাম। বোঝা গেল আমাদের মাঝে যে সংকটটা ছিল সেটা কাটিয়ে উঠতে পারে নাই। এত কিছুর পরও সে করতে পারবো? কিন্তু করলো। তারা তো আমাদের লোক, আমাদের সহকর্মী। আমাদের শিক্ষক। কোথায় যাবো? এ অবস্থার মাঝে আমরা খুব খুশি; বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া আমাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছে। খুব কাটাকাটি করে পেয়ার ইন্সপেকশন নামে নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে পরিদর্শনের উদ্যোগ নিলাম। ভালো কিছু শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজেদের মধ্যে পরিদর্শন করাতে পারলে আপনাদের কাজটা অনেক কমে আসবে। শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়েই কাজ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
এরপরও যদি কেউ দুর্নীতি করেন, এটা অজানা থাকবে না। আমি একটা কথা প্রায়ই বলে থাকি, সিলেটে একটা কথা আছে, যত মরা ভাইসে যায় পদ্মা নদী ছঁইয়া যায়। আমি মরা-ধরা যা-ই হই না কেন, আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদ্মা নদী। এমন কোনো মাথা নাই এমন কোনো ঘটনা নাই যে আমি জানি না। সব কিছু জানলেই যে আমি লাফ দিয়ে উঠবো তা-ও আমি মনে করি না। আমি এটা বিচার করি, বিবেচনা করি, মনের কথা হয়তো বলিও না, কাজে লাগাই। আপনার স্বার্থে আপনি আমার কাছে এসে বলবেন- এ কাজটা আমি করছি। সে এমন লোকের কাছে বলে যাবেন যে, কথাটা আমার কাছে চলে আসবে। নিজেরা নিজেদের সম্পর্কে বলবেন, আলোচনা করবেন। আমিও এ-ও জানি, এখানে কী পরিমাণ বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে সংঘাত আছে, এমন বিশ্রী বিশ্রী প্রচারণা একজনের বিরুদ্ধে অন্যজন চালায়, মনে করেন আমি জানি না। মেয়েরা মেয়েদের সর্ম্পকে কী পরিমাণ খারাপ খারাপ কথা বলে অনুমান করতে পারবেন না। আপনারা মনে করবেন আমি জানি না? আমার কানে অটোমেটিক চলে আসবে। শুধু আমি না আরও পদ্মা নদী আছে। ছোট ছোট পদ্মা নদী, বড় পদ্মা নদী। সব মিলিয়ে আমাদের টিম ও লিডারশিপ খুবই স্ট্রং। আপনারাও খুব স্ট্রং হইছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা থাকতে পারে, তবে মনে করবেন না আমি জানি না। না জানলে আমরা কীভাবে জানলাম উনি চা খেতে যাবেন আর আমরা উনাকে ধরবো।
ওই শিক্ষকরা তাকে ধরাতে রাজি হয়নি। তারা ভয় পায়। উনি লেখেই দিয়ে আসছেন টাকা যদি না দিবা তবে খারাপ হবে। এখানে আমরা অনেকেই ধরছি। এখানে চাকরি করে ঢাকা শহরে একজন ১৩টি বাড়ি করছে। বাড়ি সব যে ধানমন্ডি গুলশানে তা নয়। বিভিন্ন এলাকায় আশপাশে বা দূরে। বৃদ্ধিমান লোক তো জমি কিনে রাখছে পরে জমির দাম বাড়ছে তারপর বাড়ি বানাইছে। নানা জায়গায় এরকম হইছে, সব জায়গায় এ রকম হইছে। খালি যে অফিসার চোর তা না, মন্ত্রীরা চোর, আমিও চোর। আমি না হলেও দুনিয়াটা এভাবে চলে আসছে। এই অবস্থার মধ্যে আমাদের সবাইকে পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের খারাপ যে দিকগুলো সেগুলো ত্যাগ করতে হবে, ভালো দিকগুলো ফুটিয়ে তুলতে হবে। এ সম্ভবনাটা আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে। আমরা এটা করতে পারি। বাস্তবে এটা সম্ভব। এক সময় দারিদ্র্য সম্বল ছিল। এখানে মানুষ তিন হাজার বছর ধরে বাস করে। কোনো দিন স্বাধীন ছিলাম না। পেট ভরে ভাত খেতে পারেনি।  এখন আমরা স্বাধীন।

No comments

Powered by Blogger.