প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

সবার জীবনেই প্রত্যাশা থাকে। কারও প্রত্যাশা সহজেই পূরণ হয়, কারও হয় বিলম্বিত। আবার কারও প্রত্যাশা মোটেই পূরণ হয় না। পেশাজীবী হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রত্যাশা হল, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মর্যাদা ও বেতন প্রাপ্তি। অথচ স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও তারা এক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দীর্ঘ ৩ বছর ধরে প্রক্রিয়াধীন বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সময়ক্ষেপণ করে চলেছে। শিক্ষকরা সর্বমহলে সম্মানের পাত্র। অথচ সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা ও বেতন না দিয়ে তাদের সব সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে শহীদ মিনারে আসতে বাধ্য করেছে। এ আন্দোলনে প্রশাসনের দালালরা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। সহকারী শিক্ষকদের এ বৈষম্যের চ্যালেঞ্জ হল নেতৃবৃন্দের ঐক্য বজায় রাখা। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৭ সালের একটা ঘটনা তুলে ধরতে চাই। মরহুম মির্জা গোলাম হাফিজ তখন ছিলেন একাধারে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ঢাকা-৬ আসনের সংসদের সদস্য। তখন সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাজুক অবস্থা। বিদ্যালয়ের বার্ষিক কন্টিজেন্সি ছিল সর্বমোট ২৪ টাকা। ১৫ জন ওয়ার্ড কমিশনার ও তৎকালীন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (ঢাকা) মরহুম আজিজুল হক এবং প্রাথমিক শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে আমি স্পিকার মহোদয়ের কক্ষে এলাকার প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা নিয়ে আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলাম। তৎকালীন ওয়ার্ড কমিশনাররা বিদ্যালয়ের আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে মাসে ২ টাকা দেয়ার জন্য জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শককে (ঢাকা) নাস্তানাবুদ করেন। বিদ্যালয় পরিদর্শক মহোদয় তার বক্তব্য সিনেমার একটা গানের কলি দিয়ে শুরু করেন- আমরা পুতুল, ‘যেমনি নাচায় তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ’।
অর্থাৎ সরকার ২ টাকা বরাদ্দ দেয়, আমরা তা-ই দেই। এক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমার অপরাধ কোথায়? রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমনের সময়ে শুরু হয় বৈষম্যের প্রথম ধাপ। প্রধান শিক্ষকের বেতন ৩২৫ টাকা, সহকারী শিক্ষকের ৩০০ টাকা। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে ২০০৬ সালে প্রাথমিকের ননট্রেইন্ড শিক্ষকরা এমএলএসএসের স্কেল থেকে মুক্তি পেলেও সহকারীদের বেতনবৈষম্য বেড়েছে দ্বিতীয়বার। সে আন্দোলনে আমাকে জেলে যেতে হলেও প্রাথমিক শিক্ষকরা কাক্সিক্ষত স্কেল পায়নি। বর্তমান সরকারের আমলে বৈষম্য বেড়েছে তৃতীয়বার। আমাদের সময়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ভীত ছিল। গভর্নর মোনায়েম খানের আমলে বঙ্গভবন ঘেরাও করে প্রথম স্কেল আদায় করে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি তার ভালোবাসার কারণে ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, ১৯৭৫ সালে শিক্ষকদের থানার বাইরে বদলি রোধ করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে তিন লাখ প্রাথমিক শিক্ষক ঢাকা অবরোধ করেন। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষক নেতাদের মধ্যে শিক্ষকদের দাবির চেয়ে নিজেদের সুবিধা আদায়ের প্রবণতাই লক্ষ করা যায় বেশি। সরকারের সংশ্লিষ্টরা তাদের শিক্ষকদের নেতা হিসেবে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সরকারি ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে প্রাথমিকের অনেক সংগঠন। সহকারী শিক্ষকদের এ বৈষম্য নিরসনে তাদের আন্তরিকতা ও প্রভাব ছিল না। সব বৈষম্যের জন্য দায়ী সরকারের সংশ্লিষ্টরা। সেক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকদের ওপর দোষারোপ করা নেতৃত্বের বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বেতন একধাপ বাড়লে প্রধান শিক্ষকদের আরেক ধাপ বাড়ানোর দাবি করা যায়। আর প্রধান শিক্ষকদের বেতন বাড়লে সহকারীরা দাবির যৌক্তিকতা খুঁজে পায়। আজ প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে যাওয়ায় সহকারীদের নিচের স্কেল দাবি যৌক্তিক। প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডের দাবি আপাতত স্থগিত ঘোষণা নিছক নেতৃত্বের মানসিকতার বিষয়। আসুন আমরা প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক সবাই একই পরিবারের সদস্য হিসেবে হাতে হাত রেখে নিজেদের অধিকার, ন্যায্য পাওনা আদায়ে এগিয়ে যাই। মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ২৫ ডিসেম্বর তার বক্তব্যে বলেছিলেন, আন্দোলন করে দাবি আদায় করা যায় না। দাবি আদায়ের পথ হল আলাপ-আলোচনা। অথচ ২৬ ডিসেম্বর মন্ত্রী মহোদয় নিজেই স্বীকার করেছেন, এ অনশন সারা দেশে সব মহলে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। বিগত ৩ বছরে মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে যেসব আলোচনা হয়েছে- সবই যেন শুভঙ্করের ফাঁকি। আন্দোলনের নেতাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বৈষম্যের বিষয়টি নতুন করে বোঝাতে হবে। প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড স্থগিতের আশ্বাস সংশ্লিষ্টদের একটি চক্রান্ত। প্রধান শিক্ষক ও সহকারীদের দ্বন্দ্ব বজায় রেখে নেতাদের মাথায় হাত বুলিয়ে সাময়িক পার পাওয়া যাবে। শিক্ষকদের ক্ষোভ ও হতাশা মাননীয় মন্ত্রী, সচিব ও মহাপরিচালকসহ গণমাধ্যমের সাংবাদিকসহ সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। সময়ক্ষেপণ করে প্রধান শিক্ষক ও সহকারীদের দ্বন্দ্বের মাঝে ঠেলে দিলে সে ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রাথমিকের মাত্র তিনটি সংগঠন ২৩ ডিসেম্বর অনশনের ডাক দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানায়। নেতৃত্বের মান-অভিমানের চেয়ে তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সারা দেশের কর্মসূচি সফল করার জন্য প্রায় সব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সূচনা হয়। ঐক্যই শক্তি। এ শক্তি সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম
siddiqsir54@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.