কর্ণফুলীর পাড়ে শুঁটকির ঘ্রাণ by সারোয়ার সুমন

'লাক্ষ্যা হুঁনির তরকারি বেশি অইয়ে ঝাল/কী সালুন রাইন্ধে বউয়ে/পুরি যারগৈ গাল'- আবদুল গফুর হালীর কথায় শিল্পী শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষষ্ণবের গাওয়া আঞ্চলিক এ গানেই লুকিয়ে আছে যেন শুঁটকির গুণাগুণ। শীত এলে এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয় শুঁটকি। আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে শুঁটকির জনপ্রিয়তা এখন সারাদেশে। রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে শুরু হয় শুঁটকি তৈরির ধুম। নদীর ওপারে থাকা পটিয়ার ইছানগর, ডাঙ্গারচর, জুলধা ইউনিয়ন এবং কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় তৈরি হচ্ছে রূপচাঁদা, লাক্ষ্যা, হাঙর, টাইট ও কেঁচো নামের শুঁটকি। এপারে থাকা চরচাকতাই ও পাথরঘাটা এলাকার বাতাসে পাওয়া যাচ্ছে ছুরি ও লইট্টা শুঁটকির ঘ্রাণ। উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ায় আছাদগঞ্জ ও চাকতাইয়ের বড় মোকামে চলছে যেন শুঁটকি উৎসব।

ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, প্রতিবছর দেশে শুঁটকির চাহিদা প্রায় ৬০ হাজার টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত শুঁটকি দিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টনের চাহিদা মেটানো হয়। বাকি প্রায় ৩৫ হাজার টন আমদানি করতে হয় মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে। এটি মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া দেশে উৎপাদিত শুঁটকির ২০ শতাংশ রফতানি করা হয়।

যেভাবে তৈরি হয় শুঁটকি স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ী ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীত মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদন সুবিধাজনক হওয়ায় এ সময়টাকে বেছে নেন তারা। এ সময় বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া ও টেকনাফের গভীর সাগরে গিয়ে মাছ সংগ্রহ করেন জেলেরা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসব মাছ নদীতীরবর্তী এলাকায় নিয়ে আসা হয় শুঁটকি উৎপাদনের জন্য। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুঁটকি শুকানো হচ্ছে কয়েক ধাপে। প্রথমে মাছের পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে একটি দল। আরেকটি দল পেট কাটা মাছ ধুয়ে নেয় পানিতে। আরেকটি দল সেই ধোয়া মাছ শুকাচ্ছে। কেউবা হালকা শুকানো মাছে লাগাচ্ছে লবণ। শুঁটকি নিয়ে এমন কর্মব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেছে ইছানগর ও পাথরঘাটা গ্রামের শত শত মানুষকে। তাদের মধ্যে আছে নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর। শিশু-কিশোরদের প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। নারী শ্রমিকরা পান দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আর পুরুষরা পান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

সবচেয়ে দামি শুঁটকি লাক্ষ্যা

পটিয়ার ইছানগর এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী আজমল হুদা জানান, শুঁটকির বাজারে সবচেয়ে বেশি দাম লাক্ষ্যার। বাজারে ভালো মানের প্রতি কেজি রাঙ্গাবালির লাক্ষ্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে

সাড়ে তিন হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়। ২ থেকে ১৫ কেজি ওজনের লাক্ষ্যা শুঁটকিও আছে বাজারে। এ হিসাবে ভালো মানের ১৫ কেজি ওজনের একটি লাক্ষ্যা শুঁটকির দাম ছাড়িয়ে যায় অর্ধলাখ টাকা। মাঝারি মানের লাক্ষ্যা শুঁটকি দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুঁটকির বাজারে কদর আছে রূপচাঁদারও। ভালো মানের প্রতি কেজি রূপচাঁদা বিক্রি হচ্ছে চার হাজার ২০০ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়। মাঝারি মানের রূপচাঁদা প্রতি কেজি তিন হাজার ৩০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার এবং ছোট সাইজের রূপচাঁদা এক হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া লইট্টা ২৭০, ফাইশ্যা ১৮০, হাঙর ৩৪০, বাইল্যা ২২০, ফোপা ৩১০, অস মাছ ২০০, চাঁদা বাইল্যা ১২০, ফটকা ১৫০ ও টিক্কা শুঁটকি তারা বিক্রি করে ১২০ টাকা কেজিতে। নুন ইলিশ শুঁটকি প্রতিটি ১৮০ থেকে ২২০ টাকা ও নাইল্যা শুঁটকি ১৭০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ছুরি শুঁটকির পাইকারি মূল্য ১৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।

সরেজমিন চিত্র

ইছানগর গ্রামের ডাঙ্গাচর, জুলধা, কর্ণফুলী এলাকায় দেখা যায়, বেশ কয়েকটি চাঙ (শুঁটকি শুকানোর বিশেষ ব্যবস্থা)। এসব চাঙে মাছ শুকানো হয় আলাদা আলাদাভাবে। কোনো চাঙে লইট্টা। কোনো চাঙে ঝুলছে ফাইশ্যা। শুঁটকি ব্যবসায় যুক্ত থাকা ডাঙ্গারচরের রাবেয়া বেগম বলেন, 'আমার চাঙে কাজ করছে ১৫ শ্রমিক। পরিবারের ছয় সদস্য এ কাজে যুক্ত। প্রতি মৌসুমে প্রায় ছয় লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি করি।'

একাধিক চাঙের মালিক আবদুর রহমান বলেন, 'লাক্ষ্যা মাছকে শুঁটকি করা একটু জটিল। সব শ্রমিক এ কাজ করতে পারেন না। এ মাছের শুঁটকি করে তা বিদেশেও রফতানি করছি। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৩৫ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি করি।' তারা জানান, হাঙর ও বড় লাক্ষ্যা শুকাতে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে। আর ফোপা, বাইল্যা, রূপাচাঁদাসহ বেশিরভাগ মাছ শুকিয়ে প্রস্তুত করতে লাগে দুই থেকে চার দিন। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে শুঁটকি এভাবে মিশে থাকাতেই হয়তো বলা হয়- 'শুঁটকি, সারেং, দরগাহ/ এ তিন নিয়ে চাটগাঁ'।

No comments

Powered by Blogger.