ঝাঁপা বাঁওড়ে ভাসমান সেতু

‘বাঁওড়’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নদীর বাঁক। কোনো স্র্রোতস্বিনী নদীর স্রোতধারা দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যে অংশটি মূল স্রোতধারা থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে সেই অংশকে বাঁওড় বলা হয়। গঙ্গা নদী থেকে ভৈরব ও কপোতারে জন্ম। ভৈরব ও কপোতারে সংস্পর্শে প্রায় ৩৯টি ছোট-বড় বাঁওড়ের সৃষ্টি হয়েছে। ঝাঁপা বাঁওড় তার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন ঝাঁপা। এ ইউনিয়নের ঝাঁপা গ্রামের চার পাশ ঘিরে রেখেছে ঝাঁপা বাঁওড়। সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার বিস্তৃত গ্রামটি যেন একটা উপ-বদ্বীপ। এ গ্রামের ভোটার সংখ্যা সাড়ে আট হাজার আর লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এ গ্রামে রয়েছে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দু’টি মাদরাসা ও দু’টি হাইস্কুল। ঝাঁপা বাঁওড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার এবং প্রস্থ’ প্রায় এক কিলোমিটিার। বর্তমানে বাঁওড়ের আয়তন ৬৪০ একর। মূল জলাশয়ের গড় গভীরতা ১৫-১৬ ফুট। বার্ষিক মাছের উৎপাদন প্রায় ১৩০ টন। বাঁওড় থেকে বার্ষিক প্রায় ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয়। তবুও ঝাঁপা বদ্বীপের মানুষ উচ্চশিক্ষা ও আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত।ম রাজগঞ্জ বাজারের সাথে ঝাঁপা গ্রামের যোগাযোগের মাধ্যম নৌকা। এ দু’টি গ্রামের মধ্য ঝাঁপা বাঁওড় হওয়ায় শত শত বছর ধরে ঝাঁপা গ্রামবাসী নৌকায় করে রাজগঞ্জ বাজারে আসেন। এখান থেকে যান উপজেলা বা জেলা সদরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। নৌকায় পার হয়ে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করে এলাকার শত শত শিার্থী। এ বাঁওড়ের ওপর সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে এলেও কোনো সরকার তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়নি। এ নিয়ে ঝাঁপাবাসীর মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ-অভিমান। গ্রামবাসীর বহু বছরের এ দুর্ভোগ কমানোর উদ্যোগ নেয় ঝাঁপা গ্রামের যুবসমাজ। তাদের উদ্যোগ ও গ্রামবাসীর নিজস্ব অর্থায়নে বাঁওড়ের ওপর ভাসমান সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সেতু নির্মাণের জন্য গঠন করা হয় ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে তারা নির্মাণ করছেন প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর এক হাজার ফুট দীর্ঘ লোহার সেতু। কোনো প্রকৌশলী দিয়ে নয়, নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮৩৯টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮০০ মণ লোহার পাত ও ২৫০টি লোহার সিটের মাধ্যমে একের পর এক ড্রাম যুক্ত করে নির্মাণ করা হচ্ছে চার ফুট চওড়া দীর্ঘ সেতুটি। বাঁওড়ের ওপর সেতু হওয়ায় খুশি ঝাঁপার মানুষ। সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল, ভ্যান, নসিমন, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস পারাপার হতে পারবে বলে দাবি করেছে এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। আসছে জানুয়ারিতেই সেতুটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে জানা গেছে। বাঁকড়া কলেজের প্রভাষক ঝাঁপা গ্রামের বসিন্দা আশরাফ-উজ-জামান বলেন, রাজগঞ্জ বাজার ও ঝাঁপা গ্রামের মাঝখানে এ বাঁওড়, যা এক কিলোমিটার বিস্তৃত। সেতু না থাকায় আমাদের সমস্যার শেষ নেই। রাত ৯টার পরে রাজগঞ্জ থেকে আর ঝাঁপায় আসা যায় না। কারণ রাতে নৌকা চলে না। আর কেউ অসুস্থ হলে বিপদের শেষ নেই। স্কুল, মাদরাসা, বাজার সবই ওপারে। আমরা বড় অসহায়। তাই যুকদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। শিক্ষার্থী ফাহিম ও সজীব বলেন, সেতু হলে আর নৌকার জন্য ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারব। ঘাটের মাঝি শেখর চন্দ্র বলেন, আমরা ঝাঁপা গ্রামের তিনজন মাঝি নৌকায় লোক পারাপার করি। এই করে তিন পরিবারের ১৫ জনের পেট চলে। কমিটি বলেছে, সেতু চালু হলে আমাদের কাজ দেবে। সেতু পার হওয়া লোকজনের কাছ থেকে আমরা টাকা তুলব। সেখান থেকে আমাদের সংসারের খরচ দেয়া হবে। তাই আমাদের কোনো আপত্তি নেই। উদ্যমী যুবক শফিকুল জামান বলেন, এ বাঁওড়ের ওপর সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে এলেও কোনো সরকার তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। গ্রামবাসীর বহু বছরের এই দুর্ভোগ কমাতে জোটবদ্ধ হয় ঝাঁপা গ্রামের যুবসমাজ। যুবকদের উদ্যোগ আর গ্রামবাসীর নিজস্ব অর্থায়নে বাঁওড়ের ওপর ভাসমান সেতু তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। দ্রুত সেতু চালু হবে। ফাউন্ডেশনের সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল বলেন, চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি আমরা গ্রামবাসীকে নিয়ে প্রথম বৈঠকে বসি। কয়েক দফা আলোচনার পর গ্রামের যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় ঝাঁপা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এরপর সবাই ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে জমা দিয়ে তৈরি করা হয় তহবিল। পরে আগস্ট মাসের দিকে শুরু হয় ভাসমান সেতু তৈরির কাজ। তিনি আরো বলেন, প্রকৌশলীর সাথে পরামর্শ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের দফতরেও কথা বলা হয়েছে। সবাই সেতু তৈরিতে মত দিয়েছেন। জানা গেছে, আগামী ১ জানুয়ারি সেতুটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেয়া হবে। আগে খেয়া পারাপারের জন্য মাঝিদের গ্রামবাসী সপ্তাহে পাঁচ টাকা করে আর বছরে এক মণ করে ধান দিতেন। একই খরচে গ্রামবাসী সেতুটি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্য এলাকার লোকজন যেমন টাকা দিয়ে খেয়া পারাপার হতেন এখন সেতু পার হতেও তাদেরকে সেই খরচ দিতে হবে। আর এই টাকা সংগ্রহ করবেন ঘাটে নৌকা চালানো সেই চার মাঝি। এতে করে মাঝিদের সংসার যেমন চলবে তেমনি উঠে আসবে সেতু নির্মাণের খরচ। চলবে সেতু মেরামতের কাজও। এ ব্যাপারে ঝাাঁপা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুল হক মন্টু বলেন, এই সেতুর মাধ্যমে ঝাঁপা গ্রামের মানুষের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে। গ্রামবাসীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান তিনি। তবে তিনি ঝাঁপা বাঁওড়ে সরকারি অর্থায়নে স্থায়ী সেতু নির্মাণের দাবি জানান। মনিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, ঝাঁপা বাঁওড়ের ওপর সেতু তৈরির কাজ আপনারা যেমন দেখেছেন তেমনি আমিও দেখেছি। কমিটির কেউ আমাকে বিষয়টি জানায়নি। সেতু পারাপারে গ্রামবাসীর নিজেদের মধ্যে অর্থ আদায়ের বিষয় থাকতে পারে। সেটি তাদের ব্যাপার। তবে এ ব্যাপারে অতিরঞ্জিত কিছু হলে বা অভিযোগ পেলে তখন আমাদের হস্তপে করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.