বিষাক্ত তামাকের আগ্রাসন

কক্সবাজার শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরের গ্রাম ‘বোমাংখিল’। রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের এই গ্রামে পাঁচ বছর আগেও ফসলি গ্রাম ছিল। এখান থেকে উৎপাদিত শীতকালীন সবজি রামু ও কক্সবাজার শহরের চাহিদার বড় একটা অংশ পূরণ করত। এখন পুরো গ্রামের জমিতে বিষাক্ত তামাকের চাষ চলছে। কৃষি বিভাগ জানায়, গ্রামে আবাদি জমির পরিমাণ ৪১২ একর। এর মধ্যে ৩২০ একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। ২০১৫ সালে এই গ্রামে তামাক চাষ হয়েছিল ২৭০ একর জমিতে। এর আগে ২০১২ সালে গ্রামের ১২০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়। অর্থাৎ প্রতিবছরই গ্রামের ফসলি জমি একটু একটু করে চলে যাচ্ছে বিষাক্ত তামাকের দখলে। উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উত্তম কুমার বলেন, বোমাংখিল গ্রামে ৪৫০ পরিবারের বসতি। জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ পরিবার সরাসরি তামাক চাষে জড়িত। বাকি ১০০ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অনেকে তামাক খেতে শ্রমিকের কাজ করেন। স্থানীয় চাষীরা জানান, আশপাশের এলাকার মধ্যে বিষাক্ত তামাকের ‘বীজতলা’ তৈরির কাজ সবার আগে শুরু হয় এই গ্রামে। অথচ পাঁচ বছর আগেও এই গ্রামের ৩০০ একর জমিতে ধান, তরমুজ, মুলা, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদিত হতো। ধীরে ধীরে সব তামাকের দখলে চলে গেছে বলে জানান গর্জনিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু মো. ইসমাইল। গত শনিবার সকাল সাতটায় বোমাংখিল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুরো এলাকা। শীত উপেক্ষা করে মাঠে নেমেছেন চাষিরা। তামাকের বীজতলায় পানি ছিটাচ্ছিলেন কৃষক আবু ছিদ্দিক (৩২)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ধান বা শীতকালীন সবজি চাষের তুলনায় তামাকে লাভ থাকে দুই গুণ। তাই গ্রামের মানুষ তামাক চাষের ঝুঁকছে। একই গ্রামের তামাকচাষি শাকের আহমদ (৪৫) বলেন, বিভিন্ন তামাক কোম্পানি চাষিদের উৎসাহিত করে। এখানকার চারা ছড়িয়ে দেওয়া হয় রামু, চকরিয়া, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। তামাক কোম্পানির লোকেরা চাষিদের বিনা মূল্যে তামাক বীজ সরবরাহ করেন। রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, খাউয়ারখোপ ইউনিয়নের অন্তত ২ হাজার একর জমিতে এখন বিষাক্ত তামাক চারা রোপণের কাজ চলছে। আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে খেত থেকে তামাক পাতা কেটে চুল্লিতে পুড়িয়ে তামাক উৎপাদিত হবে। যা দিয়ে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিড়ি-সিগারেট, জর্দা বানানো হবে। বোমাংখিল গ্রামের বাসিন্দা মুহিবুল্লাহ চৌধুরী বলেন, তামাক চাষ স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জেনেও গ্রামের চাষিরা অধিক লাভের আশায় মাঠে নেছেন। তামাক কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে চাষিদের নানা প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করছে। ‘তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এ রকম সতর্কবাণীর বড় বড় সাইনবোর্ড গ্রামে টাঙানো গেলে চাষিরা সচেতন হতেন। রামুর কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, গত মৌসুমে (২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত) উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে প্রায় ৩ হাজার একর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছিল। এবার প্রায় ২ হাজার একর জমিতে তামাক চাষের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। রামুর গর্জনিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম বলেন, নীল চাষের মতো এখন তামাক চাষের জন্য চাষিদের বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে এলাকায় সবজি উৎপাদন কমছে। রামুর পাশের উপজেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, গত মৌসুমে তাঁর ইউনিয়নে প্রায় ৯০০ একর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছিল। বিষাক্ত তামাক চাষ থেকে কৃষকেরা যাতে দূরে থাকেন সেই লক্ষ্যে প্রচারণা চলছে বলে জানান নাইক্ষ্যংছড়ির কৃষি কর্মকর্তা শেখ মুনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, গত নভেম্বর মাসে একাধিক কর্মশালার মাধ্যমে উপজেলার ১২০০ কৃষককে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তামাকের পরিবর্তে ভুট্টা, বাদাম, বিটি বেগুন চাষ করতে তাঁদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কৃষকদের মধ্যে বিনা মূল্যে সবজি বীজও বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তামাক চাষের জমির পরিমাণ কমছে না।

No comments

Powered by Blogger.