হত্যার আসামিদের স্পর্ধা দেখি

১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণে ও ২৩ ডিসেম্বর প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে দুটি খবর ছাপা হয়। ১৮ ডিসেম্বরের খবর হচ্ছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার আসামিরা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সম্মেলনে তাঁরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বলেন, চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার নকশার অংশ হিসেবে তাঁদের বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বরের খবর হচ্ছে, দিয়াজ হত্যা মামলার দুই আসামিসহ তিনজনকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের অধীন এক বছর মেয়াদি বিপিএড (ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন) কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। খবর দুটি পড়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। একটি হত্যা মামলার আসামিরা কীভাবে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করেন? তাঁরা দোষী কি নির্দোষ, সেটা তো আদালতে প্রমাণিত হবে। এভাবে সংবাদ সম্মেলন করার সাহস পান কীভাবে তাঁরা? আর কোন বিবেচনাতেই আসামিদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? গত বছরের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় নিজ বাসা থেকে দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে—এই অভিযোগ এনে ওই বছরেরে ২৪ নভেম্বর তাঁর মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু (বর্তমানে কমিটি বিলুপ্ত), সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, দিয়াজকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। আসামিরা সব ‘প্রভাবশালী’। ক্ষমতার দাপটে তাঁরা পার পেয়ে যেতে পারেন—শুরু থেকেই এই আশঙ্কা ছিল দিয়াজের মায়ের। এ কারণে ছেলের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের কাছে ধরনা দেওয়া এবং খোলা চিঠি লেখা—সবই করেছেন তিনি। কিন্তু কিছুই হয়নি। এক বছর পরও ছেলে হত্যার বিচারের কোনো আশা দেখতে না পেয়ে দিয়াজের মা আমরণ অনশনের পথ বেছে নেন। গত ২৭ নভেম্বর থেকে অনশন শুরু করেন তিনি। সাত দিন পর পুলিশ, মহানগর ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। কিন্তু এখন কী দেখছেন তিনি? ছেলে হত্যার আসামিরা প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করছেন! পুলিশ বলেছিল, দিয়াজ হত্যা মামলার আসামিরা পলাতক। তাহলে কী করে তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করেন। আর পুলিশ তখন কেন তাঁদের হাতেনাতে গ্রেপ্তার করল না? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কি অন্ধ হয়ে গেল? তারা কী করে হত্যা মামলার আসামিদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়? তবে শুধু এ ক্ষেত্রে নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রই দেখা যায়, এসব খুনি-ধর্ষক যদি প্রভাবশালী হয়, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী হয় বা সম্পদশালী হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তাদের আইনের হাতে আনতে গড়িমসি চলবেই। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নিতে পুলিশ অনীহা দেখায়, গ্রেপ্তারে অনীহা দেখায়। যেমনটি দেখিয়েছিল বনানী থানার পুলিশ আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে শাফাত আহমেদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে করা ধর্ষণ মামলা নিতে। একসময় মামলা নিলেও তাঁদের গ্রেপ্তার করতে চাইছিল না পুলিশ। এই অনীহার পেছনে কারণ ছিল আসামিরা আর্থিকভাবে প্রচণ্ড প্রভাবশালী। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতার কথা না শুনলে চাকরি হারানোর ভয় আছে। সে জন্য নেতারা যেভাবে চান, সেভাবেই কি কাজ করে পুলিশ? তাহলে কি এ দেশের পুলিশ এখন ক্ষমতাসীনদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে? রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করাই কি তাদের প্রধান কাজ। আইন, নীতি, নৈতিকতা—এসবের কোনো গুরুত্বই নেই? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হয়েও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকা বিষ্ময়কর। পুলিশের এসব নেতিবাচক ভূমিকা আমাদের হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করে। চোখে অন্ধকার দেখি। তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? যাদের টাকা নেই, ক্ষমতা নেই, যাদের মাথার ওপর রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া নেই, তারা কি তাহলে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে? প্রশ্ন হচ্ছে, কবে এসবের অবসান হবে? কবে পুলিশ সাধারণ মানুষের সত্যিকার বন্ধু হবে। নিজেদের ভাবমূর্তি উদ্ধার করা ও তাদের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পুলিশেরই।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.