ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

উনিশশ’ একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা পেরিয়ে এসেছি সাড়ে চার দশকেরও অধিক সময়। স্বীকার না করার কোনো উপায় আছে কি, দীর্ঘ এই সময় পরিসরেও আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত হয়নি। বরং কখনও কখনও কোনো কোনো প্রসঙ্গ দেখে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আমরা বহু দূরে সরে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছে, কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তারাই সরকার গঠনে ভূমিকা পালন করেছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি প্রবল বিক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলগুলোও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রেই আমরা বিশাল এক স্বপ্ন দেখতে পারি। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ধ্বংসে অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে পারবে না, ভোটের রাজনীতির নামে অদ্ভুত এক বাস্তবতার কথা তুলে গণতান্ত্রিক শক্তি জয়লাভের আকাক্সক্ষায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আঁতাত করবে না। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো দেশ পরিচালনা করবে- এমনই আমাদের স্বপ্ন। আমরা স্বপ্ন দেখি, রাজনৈতিক শক্তিগুলো গণতন্ত্রের ময়দানে সাপ-লুডু খেলবে না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকশিত হোক আমাদের দেশে। কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়, বরং যথার্থ বিকল্প শক্তি হিসেবে বিরোধী দল আত্মপ্রকাশ করুক। গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক দলগুলো সাম্প্রদায়িক উগ্র দলগুলোকে পরিত্যাগ করেছে ভবিষ্যতে এমনটিই দেখতে চাই আমি। এক অতুল বৈভব আর ঋদ্ধ সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশ। সুদীর্ঘ সাধনায় বহু মানুষের মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রাচীনকাল থেকেই বহির্শক্তির পৌনঃপুনিক আঘাত এসেছে। বর্তমানে বিশ্বায়ন আর আকাশ সংস্কৃতির দাপটে আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যিক পরিচয় ভয়াবহ বিপন্নতার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বপ্ন দেখছি যথার্থ কার্যক্রম গ্রহণ করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সামলে উঠেছে বিশ্বায়ন আর আকাশ সংস্কৃতির ধাক্কা। বিশ্বায়ন নামের অদ্ভুত এক ভৌতিক শক্তির দাপট থেকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে বের হয়ে আসতেই হবে। ভাবনায় আমাদের অবশ্যই থাকবে বিশ্ব নাগরিকতাবোধ; কিন্তু আমাদের সাধনায়, আমাদের কর্মে, আমাদের জীবনচরণে অবশ্যই দেশজ মৃক্তিকার স্পর্শ থাকতে হবে। তা না হলে সবকিছুই আরোপিত মনে হবে, মনে হবে টবে লাগানো বৃক্ষ। বিশ্বায়নের অদৃশ্য ভূত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে নানাভাবে গ্রাস করতে উদ্যত, সে ধ্বংস করতে চায় তৃতীয় বিশ্বের সামূহিক সংস্কৃতি। বিশ্বায়ন দেখতে চায় না তৃতীয় বিশ্বের নিন্মবর্গের মানুষের সামূহিক উত্থান। তাই বিশ্বায়ন আমাদের মিত্র হতে পারে না। পুঁজিবাদসৃষ্ট বিশ্বায়ন আসলে পণ্যের বিশ্বায়ন, বাজারের বিশ্বায়ন, মুনাফার বিশ্বায়ন। এ বিশ্বায়ন মানুষকে মুক্ত করতে চায় না। বরং করতে চায় বন্দি। আশা করব বিশ্বায়নের থাবা থেকে মুক্ত হয়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিজের পায়ে চলতে পারছে, সে সবকিছু দেখছে নিজের চোখ দিয়ে, সবকিছু বুঝছে নিজের ঘিলু দিয়ে পশ্চিমের ঘিলু দিয়ে নয়। বিশ্বব্যাপী আজ নারীর জাগরণ ঘটেছে। আমাদের দেশেও তার বাতাস লেগেছে। নারীর ক্ষমতায়নের ধারায় বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর কাছে ‘রোল মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু এখনও কি আমরা নারীমুক্তির প্রকৃত অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছি? এ কথা তো মিথ্যা নয়, এ দেশে নারীরা আজও পুরুষতন্ত্রের অদৃশ্য দাপটে বন্দি। আমি স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের পুরুষেরা প্রাকৃতি লৈঙ্গিক পরিচয় ভুলে গিয়ে নারীকে সামাজিক জেন্ডার দৃষ্টিকোণে মূল্যায়ন করতে পারছে- এমনই বিশাল স্বপ্ন আমার। কেবল পুরুষের পরিবর্তন নয়, নারীরাও আর নিজেদের কেবলি ‘মহিলা’ ভাবছে না, ভাবছে মানুষ- এমনটাই ঘটবে আগামীর বাংলাদেশে। ভাষা ব্যবহার শব্দ নির্মাণে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ অনেক বেশি জেন্ডার নিরপেক্ষ হয়ে উঠবে এমনি আমার কল্পনা।
বাংলাদেশ যৌথ সংস্কৃতির দেশ। এখানে আছে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ- আছে বাঙালি ও অর্ধশতাধিক আদি নৃগোষ্ঠীর মানুষ। সংস্কৃতির বহুত্ব এবং বৈচিত্র্য পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে একটি অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেছে। মিলিত বাঙালির সম্প্রীতিময় বন্ধন আমাদের জাতিসত্তার গৌরবিত বৈশিষ্ট্য। অথচ নানা সময়েই দেখা গেছে ধর্মান্ধ ব্যক্তি বা দল কখনও বা রাষ্ট্র পরিচালনাকারী স্বয়ং, ধর্মীয় প্রভেদ সৃষ্টি করে মিলিত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, সৃষ্টি করতে চেয়েছে মানুষে-মানুষে ধর্মে-ধর্মে ভেদ। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর এমন হীন ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ হবে প্রকৃত অর্থেই এক সম্প্রীতির দেশ। মানুষ স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করবে স্বপ্নের বাংলাদেশে। স্বার্থান্ধ দল বা গোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত হবে না ধর্ম, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে ধর্মকে নিজেদের মতো ব্যবহার বা ব্যাখ্যা করবে না, লালসালুর মজিদের মতো কোনো ব্যক্তি ধর্মকে ব্যবহার করবে না ভণ্ডামির উৎস হিসেবে- এমনি স্বপ্ন দেখি আমি। আরও কত স্বপ্ন দেখা যায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখা যায় শিক্ষা ক্ষেত্রে, কৃষি ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, পরিবেশের ক্ষেত্রে। এমনি আরও কত ক্ষেত্রে। কিন্তু এমন স্বপ্নের ভবিষ্যতের বাংলাদেশ এমনি এমনি ধরা দেবে না। এ স্বপ্ন অর্জনের পথ অনেক জটিল, সেখানে অনেক বাধা। তবু এ স্বপ্নের পেছনে ছুটব আমরা, স্বপ্নকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে সত্য করে তুলব- এমনই হোক বিজয়ের এই শুভার্থী মুহূর্তে আমাদের অঙ্গীকার। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই মাতৃভূমি ভবিষ্যতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আকাক্সিক্ষত সোনার বাংলা হয়ে উঠুক- এমনি আত্যন্তিক বাসনা আমার।

No comments

Powered by Blogger.