এক তরুণের একক সংগ্রাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ আশরাফ গত ২৫ নভেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এককভাবে অনশন করছেন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা কর্তৃপক্ষের কোনো পর্যায় থেকে কোনো রকম ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তো দেখাই যায়নি, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ওয়ালিদের ছাত্র পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের কার্যক্রমকে ‘নৈরাজ্য’ বলে চিহ্নিত করে এর মধ্যে ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা’ খুঁজে পেয়েছেন (প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭)। এই মন্তব্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ বিস্ময়কর না হলেও দুর্ভাগ্যজনক। গত কুড়ি বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ছয়জন শিক্ষক বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতা থেকেছে, কিন্তু তাঁরা কেউই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেননি। বড়জোর তফসিল ঘোষণা করে তা থেকে পিছিয়ে এসেছেন; ফলে এ নিয়ে বর্তমান প্রশাসনের অবস্থান ভিন্ন বা নতুন কিছু নয়, তাতে বিস্ময়ের উদ্রেক হয় না। তবে এটা ইতিবাচক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই দাবির পক্ষে সরব হয়ে উঠছেন, তাঁদের পক্ষ থেকে সমাবেশের আয়োজন হয়েছে। এই সমাবেশে এবং ওয়ালিদের অনশনের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ; এর বাইরেও সমর্থনের লক্ষণ দেখা গেছে। তবে এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশ সরব হয়নি, তার কারণ বোধগম্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষার্থীদের আধিপত্য সর্বজনবিদিত; অতীতে ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তিকর প্রতিবাদগুলো মোকাবিলা করার যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এর পাশাপাশি কেউ কেউ এ কথাও বলছেন যে ডাকসু নির্বাচন কেবল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের বিষয়, ফলে ডাকসু নির্বাচন হওয়া না-হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিছু যায়-আসে না। শিক্ষার্থীদের জীবনে ডাকসু ও ছাত্র সংসদের ভূমিকাকে কেবল রাজনৈতিক বলে বিবেচনাই তাঁদের এই ধারণার উৎস। কিন্তু সক্রিয় ছাত্র সংসদের ভূমিকা যে শুধু প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক নয়, সেটা উপলব্ধি করা দরকার। গত ২৭ বছরে ডাকসু (এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ছাত্র সংসদের) নির্বাচন না হওয়ার ইতিহাস সুস্পষ্টভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল। শুধু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদেরই নির্বাচন হয়নি তা নয়, দেশের কোনো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এখন নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার একটি বড় প্রতিক্রিয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত রাজনীতির ধারার অবসান। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্ররাজনীতির নামে যা টিকে আছে, তার একটা বড় অংশই হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়ে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা বণ্টনের প্রক্রিয়া। দলের নাম বদলে দিয়ে প্রধান দুই দলের ব্যাপারেই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই পরিস্থিতি গত এক দশকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এ ক্ষেত্রেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অনুপস্থিতি জবাবদিহির ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে দিয়েছে; তাতে করে শিক্ষার্থীরা বিরাজনৈতিকীকরণকেই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ‘ছাত্র’ রাজনীতিবিদের সম্পর্ক, ছাত্ররাজনীতির নামে তাঁদের আচরণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতি বিষয়েই একধরনের বিরূপ মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে বলে আমার আশঙ্কা। তরুণ শিক্ষার্থীদের সামনে প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার পথ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে সৃষ্ট রাজনীতিবিমুখতা থেকে ক্ষমতাসীনেরা সুবিধা পাচ্ছেন বলে মনে করতে পারেন, আপাতদৃষ্টিতে তা সঠিকও। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি এমন সব শক্তিকেও প্রকারান্তরে সাহায্য করে, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে এবং যারা তরুণদের কাছে আবেদন তৈরির কাজে সক্রিয়। চরমপন্থী ও উগ্র সহিংস রাজনীতির আবেদন তখনই শক্তিশালী হয়, যখন প্রচলিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পথ সীমিত হয়ে আসে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের, বিশেষত ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে বলতে গিয়ে অনেকেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসুর নেতাদের রাজনৈতিক ভূমিকাকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে ডাকসু বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতা তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। যদিও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে গত ৬০ বছরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ডাকসুর নেতারা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন; তার মধ্যে ১৯৬৮-৬৯, ১৯৭০-৭১, ১৯৮২-৮৩, ১৯৯০-৯১-এর ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, আখতারউজ্জামান ও আমানউল্লা আমানের কথা অবশ্যই স্মরণীয়। তাঁরা জাতীয় রাজনীতিতে নিজ নিজ দলের নেতৃত্বের কাঠামোয় কতটা ভূমিকা পালন করেছেন এবং করছেন, সেটা নিশ্চয় আমরা অবগত। এর বাইরেও অনেকেই ডাকসুর নেতৃত্বের আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই ডাকসুর নেতারা ছাত্রজীবন শেষে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে তাঁদের দলের নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় সাফল্য লাভ করেননি। ফলে ডাকসু সব সময় জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব তৈরি করে এমন ধারণার পক্ষে খুব বেশি প্রমাণ মেলে না। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে জবাবদিহির রাজনীতির যে তাগিদ, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নেতৃত্বপ্রত্যাশীদের যোগাযোগ তৈরির যে সুযোগ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতির বিষয়ে উৎসাহের যে প্রাণবন্ত ধারা তৈরি হয়, সেটি কেবল শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, সামগ্রিকভাবে রাজনীতির জন্যই ইতিবাচক। নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান কেবল একটি দিনের বিষয় নয়, এমনকি তা কেবল এক বছরের বিষয়ও নয়। তার প্রস্তুতি সারা বছরের বিষয়ে পরিণত হয়। নির্বাচনের প্যানেলে বিভিন্ন ধরনের সম্পাদক পদের জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের কৃতিমানদের যুক্ত করার চেষ্টা ছাত্রসংগঠনগুলোর সারা বছরের কাজের অংশ হয়ে পড়ে। এতে করে শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগও তৈরি হয় এবং তাঁদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন। সেই অর্থে ডাকসু ও অন্যান্য পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদগুলো দেশে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির একটি অনিবার্য অংশ। বাংলাদেশের রাজনীতির গত ২৭ বছরের ইতিহাস থেকে এটা স্পষ্ট যে রাজনীতি ক্রমাগতভাবে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত তা ব্যাপ্ত হয়েছে। এই বৃত্তচক্র ভাঙতে হলে যেমন জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি তুলতে হবে, তেমনি অন্যত্রও সেই ব্যবস্থার জন্য সক্রিয় থাকা দরকার। ডাকসু বা ছাত্র সংসদের ভূমিকা কেবল জাতীয় রাজনীতিকেন্দ্রিক নয়। শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের যেসব সমস্যা, তা ডাইনিং হলের খাবারের মানই হোক কিংবা পাঠাগারের উন্নতিই হোক, সেগুলোর সমাধানে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টিও যে ছাত্র রাজনীতি, সেটি বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই। যেকোনো ছাত্র সংসদের দায়িত্বের অন্যতম হচ্ছে সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, নাট্য, বিতর্ক, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মতো বিষয়গুলোর আয়োজন করা, জাতীয় দিবসগুলো পালন করা এবং বার্ষিকীসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনার ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস, অভিষেক অনুষ্ঠান, নবীনবরণ এই তালিকার উল্লেখযোগ্য দিক। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে এবং বিভিন্ন ছাত্র বা ছাত্রীনিবাসে এসব আয়োজনকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট নির্বাচিত শিক্ষার্থী ও তাঁদের সহযোগীরা সাংগঠনিক নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা এবং দলের বাইরে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেন; এগুলো ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য তাঁদের প্রস্তুত করে। এসব নিয়মিত আয়োজনকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়, তার সঙ্গে যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী দল-নির্বিশেষে যুক্ত হয়, সেটি যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে। ফলে যাঁরা ডাকসু ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিকে এই বলে নাকচ করে দিতে চান যে এটি কেবল রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ব্যাপার, তাঁরা প্রকারান্তরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ভেতরের সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের সুযোগবঞ্চিত করার কথাই বলছেন জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে। ডাকসু কত ধরনের ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় বা হতে পারে, তার একটি উদাহরণ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলা। ডাকসুর নেতাদের উদ্যোগেই এই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু ও শেষ হয়েছিল। মনে রাখা দরকার যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষই শুধু শিক্ষা লাভের জায়গা নয়।
শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষকদের কাছ থেকেই শিখবেন, সেটা আশা করাও সমীচীন নয়। শ্রেণিকক্ষের বাইরের পরিবেশ ও কর্মকাণ্ড থেকে পাওয়া শিক্ষাও কোনো অংশেই কম নয়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৯৭৯-১৯৮০ ও ১৯৮২-১৯৮৪ সালে দুই দফা ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন। এসব সাফল্যের গৌরবের পাশাপাশি ১৯৮০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের অভিজ্ঞতাও আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছি। দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পালনের সময় জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, যার অগ্রভাগে ছিল ডাকসু। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির পর তৎকালীন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক দলত্যাগী হয়ে সেনাশাসকের পক্ষে যোগ দিলে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বের অতিরিক্ত ভূমিকা পালনের অভিজ্ঞতা আমাকে একাদিক্রমে রাজনৈতিক ও রাজনীতির বাইরে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম দেখার ও বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই ডাকসু ও ছাত্র সংসদের বিষয়ে এই কথাগুলো বলা। আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.