সুতায় ঝুলছে নওয়াজ শরীফের ভাগ্য

পাকিস্তানজুড়ে আবার টান টান উত্তেজনা। কী হবে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ভাগ্যে! তিনি কি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন, নাকি তাকে অযোগ্য ঘোষণা করবে সুপ্রিম কোর্ট! অযোগ্য ঘোষণা করলে তিনি আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তখন পাকিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে! এসব প্রশ্নের ফয়সালা হয়ে যাওয়ার কথা আগামী সোমবার। ওইদিন সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারকের বেঞ্চ এ বিষয়ে রায় দেয়ার কথা। সুপ্রিম কোর্ট গঠিত জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমের (জেআইটি) অনুসন্ধানী রিপোর্ট জমা দেয়ার পর এসব আলোচনা এখন পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের সদস্যদের জ্ঞাত আয়ের উৎস ও প্রকৃত সম্পদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য খুঁজে পেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত পানামাগেট কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম (জেআইটি)। ফলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ভাগ্য এখন সুপ্রিম কোর্টের হাতে ঝুলছে। জেআইটি-এর রিপোর্ট পর্যালোচনা করছেন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ। এ বেঞ্চটি রিপোর্ট পর্যালোচনা করবে আগামী সোমবার। এদিনেই চূড়ান্ত রায় দেয়ার কথা রয়েছে। কী রায় দেবেন বিচারকরা! তা নিয়ে পাকিস্তানজুড়ে রাজনৈতিক আলোচনা। যদি বিচারকরা নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করেন তাহলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ হারাবেন। সে অবস্থায় পাকিস্তান কোন দিকে মোড় নেবে তা বলা কঠিন। ওদিকে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে জরুরি আলোচনায় বসেন নওয়াজ শরীফ নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ এর (পিএমএলএন) শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা আইনগত ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন। অনানুষ্ঠানিক এ বৈঠকে জেআইটির রিপোর্ট নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এ সময় রিপোর্ট সম্পর্কে অবহিত করা হয় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজকে। এর আগে সোমবার রাতে নওয়াজ শরীফ তার আইনজীবীদের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টে তাদের জবাব কী হবে তা প্রস্তুত করতে।  এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ও নওয়াজ শরীফের ভাই শাহবাজ শরীফ, রেলওয়ে বিষয়ক মন্ত্রী খাজা সাদ রফিক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার, পরিকল্পনা ও উন্নয়নমন্ত্রী আহসান ইকবাল, পানি ও জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রী খাকান আব্বাসী। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার জাফরুল্লাহ ও অন্যান্য সদস্যরা। পিএমএলএনের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, জেআইটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে তারা আদালতে লড়াই করবে। অনলাইন ডন বলছে, সোমবার রাতে জেআইটি তাদের অনুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো (এনএবি) অর্ডিন্যান্সের ৯ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, তার দুই ছেলে হাসান নওয়াজ ও হোসেন নওয়াজ, মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ। জেআইটি তার রিপোর্টের উপসংহারে বলেছে, ১, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর বিবাদী পক্ষের ঘোষিত আয়ের উৎস ও সম্পদের মধ্যে বিস্তর ফারাক পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে বিবাদী পক্ষ ১ বলতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে বোঝানো হয়েছে। ৬ নম্বর দিয়ে মরিয়ম নওয়াজকে বোঝানো হয়েছে। ৭ ও ৮ নম্বর দিয়ে যথাক্রমে হোসেন ও হাসান নওয়াজকে বোঝানো হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন ডন। উল্লেখ্য, পানামাগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন গত ২০শে এপ্রিল। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ পারিবারিক দুর্নীতির মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে আদালতে আর্জি জানানো হয়। ওই দিন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাতে পারেন। রাজধানী ইসলামাবাদে নামানো হয়েছিল অতিরিক্ত পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষাকারী। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেদিন জেআইটি গঠনের নির্দেশ দেন। বলেন, এ বিষয়ে জেআইটির মাধ্যমে আরো তদন্ত করতে হবে। সেই জেআইটি এখন তাদের রিপোর্ট সম্পন্ন করেছে। তারা বলছে, প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাবে গরমিল আছে। ফলে নওয়াজ শরীফের ভাগ্য কোন দিকে যায় তা দেখা এখন সময়ের ব্যাপার। ওদিকে এরই মধ্যে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন ইমরান খান নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) ও বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। এ ইস্যুতে মঙ্গলবার বৈঠক করছিলেন পিটিআইয়ের শাহ মাহমুদ কুরেশি ও পিপিপির খুরশিদ শাহ প্রমুখ। সুপ্রিম কোর্টে জেআইটির রিপোর্ট জমা দেয়ার পর তারা জাতীয় পরিষদে চাপ সৃষ্টি করবেন, যাতে নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ জেআইটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল তাতে বিচারক ছিলেন মোট ৫ জন। ওই রায় দেয়ার সময় তারা বিভক্ত ছিলেন। এর মধ্যে বিচারপতি শেখ আজমত সাঈদ, বিচারপতি ইজাজুল আহসান, বিচারপতি ইজাজ আফজাল তাদের রায়ে বলেন, নওয়াজ শরীফ পরিবারকে আর একটি সুযোগ দেয়া যেতে পারে, যাতে তারা তাদের সম্পদের হিসাব দিতে পারেন। অন্যদিকে ভিন্নমত প্রকাশ করেন বিচারপতি আসিফ সাঈদ খোসা ও বিচারপতি গুলজার আহমেদ। তারা বলেন, নওয়াজ শরীফ যেহেতু আর সৎ ও সত্যবাদী নন তাই তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত। কিন্তু বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে গঠিত হয় জেআইটি। তারা তাদের রিপোর্টে বলেছে, সৌদি আরব ভিত্তিক কোম্পানি হিল মেটালস এস্টাবলিশমেন্ট, যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি ফ্লাগশিফ ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক কোম্পানি ক্যাপিটাল এফজেডই থেকে ঋণ ও উপহার হিসেবে অনিয়মের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ এসেছে ১ নম্বর বিবাদী, ৭ নম্বর বিবাদীর কাছে। পাকিস্তানি ভিত্তিক কোম্পানিগুলো থেকে একইভাবে অর্থ এসেছে ১ নম্বর বিবাদী ও তার পরিবারের কাছে। তদন্তে এ বিষয়টি হাইলাইট করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে অফসোর কোম্পানিগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এমন অনেক অফসোর কোম্পানির সঙ্গে বৃটেনে তাদের ব্যবসার যোগসূত্র আছে- এটা ধরা পড়েছে তদন্তে। জেআইটি তার রিপোর্টে আরো বলেছে, এসব কোম্পানি মূলত ব্যবহার করা হতো অর্থ বৃটেনভিত্তিক কোম্পানিতে স্থানান্তরের জন্য। এভাবে তারা অর্থ স্থানান্তর করেছেন যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তানের কোম্পানিগুলোয়। তদন্তে আরো দেখা গেছে, ১ নম্বর ও ৭ নম্বর বিবাদী ঋণ অথবা উপহার হিসেবে ওইসব কোম্পানি থেকে পাকিস্তানে অর্থ পেয়েছেন। কী কারণে তা হয়েছে সে বিষয়ে তারা সদুত্তর দিতে পারেননি। জেআইটি যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে তা ১০টি খণ্ডের। এতে বলা হয়েছে, নওয়াজ শরীফের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে বলা হয়েছে লোকসানি খাত। তাহলে সেখান থেকে কীভাবে অর্থ আসে, তারা সম্পদশালী হন। নওয়াজ শরীফের স্ত্রী কুলসুম নওয়াজ সম্পর্কেও ওই রিপোর্টে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তিনিও পারিবারিক ব্যবসার অংশ। ১৯৮৪-৮৫ থেকে তিনি আয়কর বিবরণী জমা দিয়ে যাচ্ছেন। এ সময়কালে ১৯৯১-৯২ থেকে ১৯৯২-৯৩ এক বছরের মধ্যে তার সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৫ গুণ। ১৯৯১-৯২ সালে তার সম্পদ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার রুপি। কিন্তু ১৯৯২-৯৩ সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ২০ হাজার রুপি। অথচ এ সময়ে মাত্র ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ রুপি আয় দেখানো হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, ছেলে হোসেন নওয়াজের সম্পদ ১৯৯০-এর দশকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার ১৯৯৭-৯৮ সালে কোনো আয়ের সূত্র উল্লেখই করা হয়নি। এসব কারণে জেআইটি বিশ্বাস করছে, তাদের নামে যে সম্পদ জমা হয়েছে তা অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত। এক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পদ বাড়াতে হোসেন নওয়াজকে ‘প্রক্সি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অপর ছেলে হাসান নওয়াজের সম্পদেরও একই অবস্থা। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে তার কোনো আয়ের উৎস দেখানো হয়নি। অথচ দ্রুত তার সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা সেই সময়, যখন নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় ছিলেন। এই রিপোর্টে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারের সম্পদ সম্পর্কেও তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি ১৯৮১-৮২ এবং ২০০১-০২ সালে আয়কর রিটার্ন জমা দেননি। এর উদ্দেশ্য হলো আয়কর ফাঁকি দেয়া। জেআইটি পরিষ্কারভাবে বলেছে, ইসহাক দার অসৎ উপায়ে সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বরাক হোল্ডিংসে ৫৫ লাখ বৃটিশ পাউন্ড বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এই অর্থের উৎস কী তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে তার ছেলে তাকে মাত্র ৪৯ লাখ ৭০ হাজার পাউন্ড দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ইসহাক দার দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন ৬ কোটি ৯২ লাখ ৭০ হাজার রুপি। এর বেশির ভাগই গেছে তার নিজের প্রতিষ্ঠানে। এর মাধ্যমে ওই অর্থ নিজের কাছে রেখেছেন তিনি। এর বাইরেও পাকিস্তানে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে অর্থ পাচার শুরু হয়। তবে এফআইএ এবং এনএবি’র তদন্ত অনুযায়ী, ১৯৯২ সালের আগস্টে প্রথম অর্থ পাচার শুরু হয়। এসব লেনদেনে দেখা যায়, প্রথম দুটি অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়েছে ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এ দুটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এনবিপি) প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ ও মুখতার হোসেনের নামে। এ দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ স্থানান্তর হয় মুসা গণি ও তালাত মাসুদ কাজী নামের দুজন গ্রাহকের কাছে। সবকিছু মিলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ফের এক অনিশ্চয়তা ফিরে এসেছে। নওয়াজ শরীফ পরিবারের সম্পদের তদন্ত করতে গিয়ে জেআইটি যে রিপোর্ট দিয়েছে সোমবার তার প্রভাব পড়েছে মঙ্গলবার দেশটির শেয়ার বাজারে। সেখানে সূচকের পতন হয়েছে ২০০০ পয়েন্ট। লেনদেন শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই কেএসই-১০০ সূচকের পতন হয় ১৩০০ পয়েন্টের বেশি। দুপুর নাগাদ এর আরো পতন হয়।

No comments

Powered by Blogger.