আইন প্রণেতারাই আইন ভাঙছেন -সুজনের গোলটেবিলে বক্তারা

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার এখতিয়ার সংসদ সদস্যদের নেই। এ নিয়ে মন্তব্য করে সংসদ সদস্যরা নিজেরাই আইন ভঙ্গ করেছেন। এমপিদের ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। তাদের ক্ষমতা কখনোই সার্বভৌম নয়। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও করণীয়’ শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ৫৩, ৬৩ ও ১৩৩ ধারা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট এবং বিচার বিভাগ নিয়ে মন্তব্য করা যায় না। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিও একটি আইন। কিন্তু সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে এমপিরা এই আইন ভঙ্গ করেছেন। বিচার বিভাগ নিয়ে এভাবে তারা কোনো মন্তব্য করতে পারেন না। তিনি বলেন, বিচারক ও নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ নিয়ে এখনো কোনো আইন হয়নি। কোনো এমপি অপরাধ করলে সংসদের সুনাম যদি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যারা সংসদের মর্যাদা ও সুনাম ক্ষুণ্ন করছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া উচিত। লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আমরা সবসময়ই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলছি। কিন্তু এখন এই রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার বিচার বিভাগের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে সমালোচনা ও কথাবার্তা হচ্ছে। এখন যা দরকার সেটি হলো এর সম্মান ও মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ন না হয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ আরো বলেন, কোনো দেশের বিচার ব্যবস্থা সেই দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থার বাইরে নয়। বিচার ব্যবস্থা দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার বাইরে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তবে, সেটাই সবচেয়ে ভালো বিচার ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তির সঙ্গে ন্যায়বিচার পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিচার বিভাগে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা। দেশের মানুষের মানবাধিকার যদি ক্ষুণ্ন হয়, তা দেখার দায়িত্ব উচ্চ আদালতের। এখন উচ্চ আদালতের যদি স্বাধীনতা না থাকে তাহলে আর কিছুই থাকে না। তাই সবার আগে উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা প্রয়োজন। আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যদি সংসদ মনে করে থাকে সংবিধানের সংশোধনী আনবে, তাহলে সংশোধনী আনুক। আপনারা যদি আন্তরিক হোন তাহলে সংবিধানের আরেকটি সংশোধনী আনুন যে বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে ড. আসিফ নজরুল বলেন, সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য হয়তো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রয়োজন। কিন্তু আস্থা-অনাস্থা আর বাজেট প্রণয়ন ছাড়া ৭০ অনুচ্ছেদ-এর আর কোনো  প্রয়োজন নেই-এমন একটি আইন আপনারা করুন।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ষোড়শ  সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের আলোচনার এখতিয়ার সংসদ সদস্যদের নেই। এ নিয়ে সংসদে যে আলোচনা হয়েছে তা করতে গিয়ে সাংসদেরা নিজেরাই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সাংসদেরা সেদিন কি আলোচনা করেছিলেন তা ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে সংসদ সদস্যদের দেখার জন্য অনুরোধ জানিয়ে তিনি  বলেন, তাহলেই তারা উপলব্ধি করবেন যে তারা আসলে কি বলেছিলেন।
তিনি বলেন, সাংসদেরা কেন বলেন যে, তারা সার্বভৌম? সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। তাদের সার্বভৌম হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। বিচার বিভাগকেও জবাবদিহিতা  নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিচার বিভাগ  স্বাধীন। তবে, আমরা আরো স্বাধীন চাই। কিন্তু বিচার বিভাগেও গলদ রয়েছে। সবচেয়ে বড় গলদ আমার মনে হয় রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে এই অঙ্গতে (বিচার বিভাগ) সর্বময় প্রশাসনিক ক্ষমতা একমাত্র প্রধান বিচারপতির ওপর। ড. শাহদীন মালিক বলেন, আমরা সরকারের যতই সমালোচনা করি সিদ্ধান্তটা মন্ত্রিসভায় হয়। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর জোরালো ভূমিকা থাকে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা হয় সম্মিলিত। যত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হয় ওখানে সম্মিলিত প্রক্রিয়ায় হয়। কিন্তু বিচার বিভাগের সব প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতি একলা নেন। এটি সাংঘাতিক দুর্বল অবস্থা। এটিকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরো বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, জোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ।
এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগকে নিয়ে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের আলোচনার প্রেক্ষিতে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেছে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন। সাংসদেরা আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান সমিতির নেতৃবৃন্দ। সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদিন বলেন, সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সংসদে সুপ্রিম কোর্ট, প্রধান বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবীদের কটাক্ষ করে যে আপত্তিকর বক্তব্য রাখা হয়েছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে এমপিরা সংবিধানেরই অবমাননা করেছেন। বিচার বিভাগের মর্যাদাকে খাটো করেছেন। তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়ে যে কটূক্তি তারা করেছেন তাতে অনেকেই সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ পড়লে যে কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতেন না। এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবাদ সম্মেলনের প্রেক্ষিতে সমিতির আওয়ামীপন্থি অংশ একই স্থানে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. অজি উল্লাহ। ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সংসদের আলোচনাকে প্রাণবন্ত ও গঠনমূলক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধানের যে কোনো সংশোধনীর রায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক।

No comments

Powered by Blogger.