থোক বরাদ্দ কমে যাওয়ায় নাগরিক সেবায় ধস

দুই বছর আগেও নগরীর সৌন্দর্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোর হলে পরিচ্ছন্ন আর রাতে ঝাড়বাতির আলো মানুষকে মুগ্ধ করত। এখন ভোর আর রাতে সৌন্দর্য দূরের কথা, সাধারণ সেবাও পাচ্ছে না নগরবাসী। চার বছরে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) সব সেবায় ধস নেমেছে। এর আগে সরকারদলীয় মেয়র থাকাকালীন সরকারিভাবে থোক বরাদ্দের পরিমাণ যা ছিল, বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে এসব সেবা ধরে রাখতে পারেছে না সিটি কর্পোরেশন। তবে আগের মতো সরকারি বরাদ্দ আছে প্রকল্পগুলোয়। দেশের অন্য নগরীতে যেখানে ৪টি উন্নয়ন প্রকল্প চালু আছে, সেখানে রাজশাহীতে ৬টি প্রকল্প চলছে। রাসিকের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত থোক বরাদ্দের পরিমাণ ২৮ থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত ছিল। আর এখন বরাদ্দ ৮ কোটি থেকে ১৩ কোটি টাকায় নেমেছে। সরকারি থোক বরাদ্দের টাকা দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে ছোট ছোট নাগরিক সমস্যার সমাধান করা হতো। এখন সেই বরাদ্দ কমে যাওয়ার কারণে সেই কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৩ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ মিলেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাওয়া গেছে ১২ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মেয়র নির্বাচিত হন ২০১৩ সালের ১৫ জুন। সেপ্টেম্বরে দায়িত্ব নেন। এর মধ্যে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন দেড় বছরের কিছু বেশি। তবে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। আগের মেয়াদে সাড়ে চার বছরে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ৭৫০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন। তবে এখনও প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। সরকারিভাবে এসব প্রকল্পে অর্থও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক জানান, নগরীর উপশহর মোড় থেকে সোনাদীঘি মোড় এবং মালোপাড়া মোড় থেকে সাগরপাড়া সড়ক পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ, রাজশাহী-নওগাঁ সড়ক হয়ে রাজশাহী-নাটোর পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ, জলাবব্ধতা দূর করতে নর্দমা নির্মাণ, কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারী মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত ও উন্নয়ন, নগরীর বিভিন্ন সামাজিক ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প নামে ৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব কাজে সরকারিভাবে চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করেছে সরকার। এ ছাড়া নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে সড়ক সংস্কার কাজের জন্য সরকার সম্প্রতি ১৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ আগের তুলনায় বেড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী সরকার অর্থ বরাদ্দ করছে। কিন্তু থোক বরাদ্দের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল জানান, সরকারিভাবে চাহিদা অনুযায়ী থোক বরাদ্দ না পাওয়ায় উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তবে তিনি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে অর্থ বরাদ্দের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। থোক বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ালে নাগরিক সেবা আরও নিশ্চিত করা যেত বলে মনে করেন তিনি। প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়লেও থোক বরাদ্দ কমে যাওয়ায় নাগরিক সেবায় ধস নেমেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে সব সেবায় এমন ধস। রাতের নগরী : রাতে নগরীকে সুশোভিতকরণ ও সাশ্রয়ী বাতি লাগানো হয়েছিল। এখন অনেক বাতি বিকল। আবার বাতিসহ পুলের অস্তিত্ব নেই অনেক স্থানে। নগরীর তালাইমারি থেকে ভদ্রা মোড় পর্যন্ত রোড ডিভাইডারের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। এখনও মেরামত করা হয়নি। সেখানকার ফুলের গাছ অরক্ষিত। আলুপট্টি মোড়ের ল্যাম্প পোস্টটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। চিহ্ন এখনও আছে। ল্যাম্প পোস্টটি আর নির্মাণ করা হয়নি। হেতেম খাঁ মোড় ও রাজশাহী কলেজের সামনে পামগাছে আলোর ঝরনাধারা ছিল। সেগুলোর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাসিকের আলোকায়ন বিভাগ সূত্র জানায়, সৌন্দর্য বাড়াতে আগের মেয়রের সময় যেসব বাতি লাগানো হয়েছিল, সেগুলোর মেয়াদকাল কম ছিল। যে কারণে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর নতুন করে আর বাতি লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পদ্মাপাড়ের ওয়াইফাই জোন : পদ্মাতীর মনোরম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে সংযোজন করা হয় ওয়াইফাই। ল্যাপটপ নিয়ে তরুণদের মেলা বসত সেখানে। এখন সেই দৃশ্য আর নেই। কারণ সেখানে বসানো ওয়াইফাই প্রযুক্তি বিকল। ফলে আগের মতো জমজমাট অবস্থা নেই।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : আগে রাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হতো। এখনও সেই ধারা আছে। তবে সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের অভাবে রাস্তার পাশে দিনে জমে থাকে রাতের আবর্জনা। মধ্য নগরীতে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চললেও বাইরের ওয়ার্ডগুলোয় সেই কার্যক্রম কম। রাস্তার পাশে আবর্জনা জমা হয়ে পড়ে থাকে। সেগুলো দুই-তিন দিন পর এসে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিয়ে যান। আগে প্রতিদিন রাতেই সেগুলো নিয়ে যাওয়া হতো। রাস্তার ডিভাইডারগুলোর স্টিলের পাত নিয়মিত পরিষ্কার করা হতো। এখন সে কাজও হয় না। আগে রাস্তার পাশের ডিভাইডারগুলো সৌন্দর্যবর্ধন করত। এখন এগুলো জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে পাত কেটে নিয়ে গেছে চোরে। যেগুলো আছে সেগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো চেষ্টা নেই।
স্বাস্থ্যসেবা : রাসিক পরিচালিত সিটি হাসপাতালসহ ১৪টি আরবান হেলথ কেয়ারের বেহালদশা। নগরবাসীর অভিযোগ, আগে ১০ টাকা করে টিকিট থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। সাধারণ কিছু রোগের ওষুধও পাওয়া যেত। এখন চিকিৎসক সংকট। আর ওষুধ সেবা দেয়া একেবারেই বন্ধ আছে।
রাস্তা মেরামত নেই : রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গ্যাস সংযোগের পাইপ লাইন বসাতে গিয়ে খুঁড়তে হচ্ছে সড়ক। সড়ক খুঁড়ে গ্যাস সংযোগ নিতে গ্রাহক টাকা দিচ্ছেন সিটি কর্পোরেশনকে (রাসিক)। রাস্তা খুঁড়ে গ্যাস সংযোগ নেয়ার কাজ চললেও রাস্তাগুলো মেরামত করা হচ্ছে না। গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাস্তা খোঁড়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। তারপরও রাস্তা মেরামত করছে না সিটি কর্পোরেশন।

No comments

Powered by Blogger.