রাজশাহীর দুই শ্রমিক নেতার বিলাসী জীবন

ট্রাকচালক থেকে কামাল হোসেন রবি এখন কোটিপতি। রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই ফুলেফেঁপে উঠতে থাকেন তিনি। শ্রমিক নেতা রবি এখন আলিশান পাঁচতলা ভবনের মালিক, সড়কে চলে তার চারটি বাস ও তিনটি ট্রাক। চড়েন দামি গাড়িতে। একই সঙ্গে রাতারাতি সম্পদশালী হয়ে ওঠেন একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেনও। ইউনিয়ন করেই তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকের চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরার পর তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। বর্তমানে রাস্তায় চলছে তার ছয়টি বাস, আরও দুটি নামার অপেক্ষায়। চড়েন বিলাসবহুল গাড়িতে, রয়েছে ছয়তলা বিশাল বাড়ি, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে তার ইটভাটা, আরও কত কী। দুই শ্রমিক নেতার এ বদলে যাওয়া নিয়ে এলাকায় নানা কথা চালু আছে। বলাবলি হচ্ছে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নকে পুঁজি করেই ধনাঢ্য হয়ে ওঠেন রবি-মাহাতাব। রবি ১০ বছর ধরে রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি পদটি আঁকড়ে ধরে আছেন। ২০১১ সাল থেকে মাহাতাব সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকলেও সম্প্রতি তিনি ওই পদ থেকে ছিটকে পড়েন। সম্প্রতি শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাঙ্গামার পর বানচাল হয়ে যায় নির্বাচন। থানায় মামলা হওয়ার পর ইউনিয়ন থেকে মাহাতাব ছিটকে পড়লেও ক্ষমতাসীনদের ম্যানেজ করে সংগঠনের সভাপতি কামাল হোসেন রবি আহ্বায়ক পদ দখলে রাখেন। এরপর দুই নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নামে। আর এতেই তাদের অঢেল সম্পদের গোপন তথ্য বের হয়ে আসতে শুরু করে। শ্রমিক ও ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও অনুসন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়নের শীর্ষ পদে থেকে বিপুল অংকের অর্থ নয়ছয় করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায়। জানা গেছে, রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্রাক শ্রমিকদের নামে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে দিনে লক্ষাধিক টাকার চাঁদা ওঠে। এর ছোট্ট একটি অংশ ইউনিয়নের হিসাবে জমা হলেও বেশির ভাগই চলে যায় রবি-মাহাতাবের পকেটে। এছাড়া অতিরিক্ত ট্রিপ চলা বাস থেকে মাসিক ভিত্তিতে যে টাকা আদায় করা হয় তার পুরোটাই হাতিয়ে নেন তারা। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মোটা অংকের সেলামি না দিয়ে নতুন গাড়ি রাস্তায় চলাচল করা তো অসম্ভব। এর বাইরে বাস-টার্মিনালের নির্মাণ কাজে নয়ছয় করে রবির মোটা অংকের টাকা কামানোর বিষয়টি এক রকম ওপেন সিক্রেট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক নেতা বলেছেন, নওদাপাড়া বাস টার্মিনালের কাউন্টার বিক্রির দেড় কোটি টাকা এখনও রবির কাছে। দোকান বিক্রির ৩৬ লাখ টাকাও করায়ত্ত করেছেন তিনি। ইউনিয়ন ভবনের ছাদ নির্মাণের নামে এক কর্মকর্তার কাছ থেকে নেয়া সাড়ে ৬ লাখ টাকার হদিস নেই। এছাড়া মেলার আয়োজন করে শ্রমিক হাসপাতালের নামে পাওয়া ৬০ লাখ টাকা ছাড়াও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন এবং আঞ্চলিক ইউনিয়ন থেকে পাওয়া অন্তত কোটি টাকাও রয়েছে রবির কাছেই। এর বাইরে রবি ইউনিয়ন তহবিল থেকে ৫ লাখ টাকা ধার নিয়ে সেটাও আর ফেরত দেননি। জানা গেছে, রবি-মোমিনের নামে আরএম এক্সপ্রেসের চারটি বাস চলে রাজশাহী-পিরোজপুর, রাজশাহী-ঠাকুরগাঁও ও রাজশাহী-রংপুর রুটে। রাজাবাড়ী এলাকায় রয়েছে তার বাগানবাড়ি। নগরীর শিরোইল কলোনি এলাকায় ৫ তলা বাড়িতেই থাকেন তিনি। শ্রমিক নেতা মাহাতাব এখন ২৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে সম্প্রতি বহিষ্কার এই নেতার ৬টি বাস চলছে রাজশাহী-রংপুর, রাজশাহী-পাবনা ও রাজশাহী-ফরিদপুর রুটে। আরও দুটি বাস সড়কে নামার অপেক্ষায়। রয়েছে একাধিক দামি গাড়ি। নগরীর টিকাপাড়ায় ৬ তলা বাড়িটিও বিশাল। দুর্গাপুরের আমগাছিতে রয়েছে কোটি টাকার ইটভাটা। অভিযোগ রয়েছে, গত দুই বছরে মাহাতাব ইউনিয়নে ১০০ জনকে সাধারণ সদস্যপদ দিয়ে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া শ্রমিক তহবিল থেকে অনুমোদনহীন খরচ করেছেন ১০ লাখ টাকা। শ্রমিক ইউনিয়নের মালিকানাধীন হোটেল গোল্ডেন স্টার বিক্রির ৪১ লাখ টাকাও রয়েছে তার কাছেই। জানা যায়, মাহাতাব হোসেন রাজশাহী শ্রমিক ইউনিয়নে সদস্যপদ পান ১৯৯৮ সালে। ২০০৪ সালে যুগ্ম সম্পাদক হন। ২০১১ সালে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সিরাজের মৃত্যুর পর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হন। সেই থেকে এই পদেই ছিলেন। রবি রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নে সদস্যপদ পান ১৯৯৭ সালে। ১৯৮৮ সালে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের তিন মেয়াদে একই পদে ছিলেন। তিনবার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। একবার সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করে হেরে যান। তবে শেষ চার মেয়াদে ১০ বছর ধরে সভাপতি ছিলেন রবি। ইউনিয়নের প্রভাব খাটিয়ে অর্থ কামানোর অভিযোগ অস্বীকার করে কামাল হোসেন রবি বলেন, বিধি অনুযায়ী আর্থিক বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব সম্পাদক ও অর্থ সম্পাদকের। এমআর এক্সপ্রেস নামে যে চারটি গাড়ি চলে সেগুলোর মালিক মোমিনুল ইসলাম নামের একজন শ্রমিক নেতা ও তার ভাইয়েরা। সড়কে সুবিধা পেতেই তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে তিনটি ট্রাক থাকার কথা স্বীকার করেন তিনি। আয়ের উৎস সম্পর্কে রবি বলেন, তিনি নওদাপাড়া বাস টার্মিনালের উন্নয়ন কাজ করেছেন। ট্রাক টার্মিনাল দশ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন। এর আগে দীর্ঘদিন গাড়িচালক ছিলেন। এ থেকেই এ সম্পদ। অবৈধভাবে কোনো সম্পদ করেননি বলে দাবি করেন রবি। রবি অভিযোগে বলেন, ইউনিয়নের সব অর্থই রয়েছে মাহাতাব হোসেনের কাছে। মাহাতাব এসব টাকা মেরে কোটিপতি হয়েছেন। অডিট করে শিগগিরই ইউনিয়নের আর্থিক অসঙ্গতি বের করে আনার কথাও জানান তিনি। অভিযোগ অস্বীকার করে মাহাতাব হোসেন বলেন, তিনি ইউনিয়নের কোনো অর্থ নেননি। রবি নিজের সুবিধার জন্য অর্থ সম্পাদকের বদলে দফতর সম্পাদককে অর্থ দেখভালের দায়িত্ব দেন। তিনি কিছুই জানেন না। রবির অভিযোগ খণ্ডন করে মাহাতাব বলেন, বরং রবি ইউনিয়নের টাকা মেরে শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে সাধারণ শ্রমিকরা এ কারণে রবিকে ভোট দেয়নি। তবে সন্ত্রাস করে সে নির্বাচন বানচাল করেছে। নিজের গাড়ি-বাড়ি-সম্পদ সম্পর্কে মাহাতাব বলেন, তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ছিলেন। সেখানে চাকরি ছাড়াও ব্যবসা করেছেন। কষ্ট করে বিদেশ থেকে টাকা এনেছেন। এছাড়া বিভিন্ন রুটে তার নামে চলাচলকারী সবগুলো বাসই বিদেশে থাকা তার বোন-ভাগ্নেদের টাকায় কেনা।

No comments

Powered by Blogger.