ঈদে অতিরিক্ত ৮ কোটি টাকা আদায়

ঈদের আগে ও পরে দুই সপ্তাহ সরকারি রেটের অজুহাতে যাত্রী জিম্মি করে অতিরিক্ত ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ মালিকরা। প্রায় ১২ লাখ যাত্রী আনা-নেয়ার মাধ্যমে এ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। অবশ্য এরপরও খুশি নন মালিকরা। তাদের দাবি, লঞ্চ সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তুলনামূলকভাবে যাত্রী কম হওয়ায় আশানুরূপ লাভ হয়নি। তবে নাগরিক পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, ঈদ এলেই এভাবে সরকারি রেটের দোহাই দিয়ে অতিরিক্তি ভাড়া আদায় করা হয়। এটা বন্ধে সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এবারের ঈদে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে সর্বাধিক লঞ্চ যাত্রী পরিবহন করে। নিয়মিত চলাচলে থাকা ১৭টি লঞ্চের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয় আরও ৫টি। এর মধ্যে দিবাভাগে চলাচল করে ৩টি, ডে-নাইট ১টি এবং বাকি ১৮টি নৈশকালীন। অবশ্য ঈদের আগে-পড়ে স্পেশাল সার্ভিস চালাতে গিয়ে নৈশকালীন সার্ভিসগুলোও চলাচল করে দিনে ও রাতে। জেলা প্রশাসন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এবার লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে আগাগোড়া তৎপর ছিল প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রতিদিনই ঢাকা এবং বরিশাল ঘাটে দায়িত্ব পালন করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ র‌্যাব-পুলিশ এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফলে ডবল ডেকার লঞ্চগুলোর প্রায় কোনোটিকেই প্রতি ট্রিপে গড়ে ২২শ’ থেকে আড়াই হাজারের বেশি যাত্রী পরিবহন করতে দেয়া হয়নি।
এটি করতে গিয়ে নানা ঝামেলাও হয়। প্রায় প্রতিদিনই লঞ্চগুলোকে ঘাট ত্যাগ করতে হয়েছে নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা আগে। যে কারণে অগ্রিম টিকিট করেও লঞ্চে উঠতে পারেননি হাজার হাজার যাত্রী। এছাড়া কঠোর ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ঈদের দু’দিন পর অতিরিক্ত যাত্রী তোলার অপরাধে আটক করা হয় সুন্দরবন নেভিগেশনের দুই লঞ্চের দুই সুপারভাইজারকে। দিবা সার্ভিসে চলাচলকারী ওয়াটার বাস গ্রিন লাইন থেকে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে উঠা প্রায় ২০০ নারী-পুরুষকে যাত্রা শুরুর আগ মুহূর্তে নৌযান থেকে নামিয়ে দেন দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এসব কারণে এবার মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনে অনেকটাই ব্যর্থ হন ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ মালিকরা। বিষয়টি নিয়ে হতাশও তারা। প্রশাসনের খবরদারিতে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বহন বাধাগ্রস্ত হলেও লঞ্চ মালিকরা যে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তা নয়। বরং সরকারি রেটের দোহাই দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মাধ্যমে তারা ঘরে তুলেছেন ৮ কোটি টাকা। লঞ্চ মালিকদের সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, নিয়মিত ও স্পেশাল মিলিয়ে এবার ঈদের আগে-পড়ে একেকটি লঞ্চ গড়ে ২০ বার ঢাকা-বরিশালে আসা-যাওয়া করেছে। গড়ে প্রতিবার যদি একটি লঞ্চে ডেক শ্রেণীর ২ হাজার ৩৫০ জন যাত্রীও হয়, সেক্ষেত্রে কেবল ডেকেই একটি লঞ্চ আনা-নেয়া করেছে প্রায় ৪৭ হাজার যাত্রী। এর সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর কেবিন, সোফা এবং ভিআইপি মিলিয়ে আসা-যাওয়া করেছে আরও প্রায় ৬ হাজার। অর্থাৎ একটি লঞ্চই বহন করেছে ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ। ২২টি লঞ্চের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখ ৬৬ হাজারেরও বেশি। যার মধ্যে ডেক যাত্রী ১০ লাখ ৪০ এবং প্রথম শ্রেণী, ভিআইপি ও সোফা যাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে স্বাভাবিক সময়ে ডেক যাত্রীদের কাছ থেকে মাথাপিছু ২০০ টাকা করে ভাড়া নেয়া হলেও ঈদের আগে-পড়ে টানা ২ সপ্তাহ এ ভাড়ার সঙ্গে বাড়তি যোগ হয় আরও ৫০ টাকা। একইভাবে প্রথম শ্রেণীর কেবিন, সোফা এবং ভিআইপির ক্ষেত্রেও মাথাপিছু বাড়ানো হয় গড়ে ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। সরকারি রেটের দোহাই দিয়ে কেবল ঈদ এবং কোরবানির সময়ে এ অতিরিক্তি টাকা আদায় করে মালিকরা। বাড়তি এই হিসাবে এবার ঈদে কেবল ডেক যাত্রীদের কাছ থেকেই লঞ্চ মালিকরা অতিরিক্ত আদায় করেছে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এর সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর কেবিন ও সোফার বাড়তি ভাড়া বাবদ আদায় হওয়া ২ কোটি ৫২ লাখ যোগ করলে অতিরিক্ত হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ কোটি ৭২ লাখেরও বেশি। অবশ্য এ হিসাবের মধ্যে ধরা হয়নি লঞ্চগুলোতে থাকা ভিআইপি কেবিন থেকে বাড়তি ২ হাজার করে আদায় হওয়া টাকা। এ টাকা যোগ হলে অতিরিক্ত আদায়ের পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে ৮ কোটিরও বেশি। ঈদে বাড়তি ভাড়া আদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক এবং কেন্দ্রীয় নৌযান মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘স্পেশাল সার্ভিস, অনেক বেশি যাত্রী পরিবহন, কোটি কোটি টাকা আয়সহ অনেক কথাই বলে অনেকে। কিন্তু ঈদের সময় আমাদেরও যে অনেক বাড়তি খরচ থাকে, সে কথা তো কেউ বলে না। ঈদে লঞ্চের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বোনাস দিতে হয়। আবার যাত্রীদের সুবিধার জন্য আমরা যখন স্পেশাল সার্ভিস দিই, তখন ডাবল ট্রিপের যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে এক ট্রিপ খালি লঞ্চ চালিয়ে আমাদের ঢাকা কিংবা বরিশাল যেতে হয়। যাত্রীবিহীন খালি লঞ্চ চালিয়ে যেতে যে খরচ হয়, তার পুরোটাই তো লোকসান। তাছাড়া আমরা বেআইনি তো কিছু করছি না। সরকার নির্ধারিত রেট অনুযায়ী ডেক যাত্রীদের মাথাপিছু ভাড়া ২৬০ টাকা। সারা বছর ২০০ টাকায় যাত্রী আনা-নেয়া করি আমরা। কেবল ঈদের সময় ২৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়। প্রথম শ্রেণী, ভিআইপি এবং সোফার ক্ষেত্রেও একইভাবে সরকারি রেটে আদায় করা হয় ভাড়া। আপনারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি দেখলেন; কিন্তু সারা বছর যে আমরা কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করি সেটা তো দেখলেন না।’ লঞ্চ মালিকদের এ যুক্তি প্রসঙ্গে বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সারা বছর উনারা জনসেবার জন্যে ভাড়া কম নেন না। বছরের অন্যান্য সময়ে যাত্রীদের এত চাপ থাকে না। ফলে লঞ্চগুলোর মধ্যে চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেই তখন কম ভাড়া নেন মালিকরা। ঈদের সময় ঘটে উল্টো ঘটনা। তখন বাড়ি ফেরার তাগাদা থাকে লাখ লাখ মানুষের। সেই অবস্থায় সরকারি রেটের নামে তাদের জিম্মি করা একটি বিবেকহীন কাজ। আর সেই কাজটিই বছরের পর বছর করে আসছেন লঞ্চ মালিকরা। ঈদের সময় যেহেতু আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি আর লোকসানের আশঙ্কা নেই, তাই এ সময়ে মালিকদের উচিত ভাড়া আরও কমিয়ে নেয়া। কিন্তু তারা করছে উল্টো। বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি হয়েছে। সরকারের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। ফলে মালিকদের পকেটে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা।’

No comments

Powered by Blogger.