দক্ষিণে আ’লীগের রাজনীতিতে হাসানাত-সাদিকের আধিপত্য

বরিশালে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বলতে নগরে সাদিক আর জেলায় হাসানাত। তবে সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হলেও তার বাবা সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির বিচরণ পুরো দক্ষিণাঞ্চলে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় থাকা ২১টি নির্বাচনী এলাকা আর প্রায় সব উপজেলা-পৌরসভাতেই রয়েছে তার নেপথ্য আধিপত্য। সব মিলিয়ে বরিশাল তথা দক্ষিণের সিংহভাগ এলাকায় এখন সাদিক আর হাসানাতেই আবর্তিত ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি। নির্বাচন থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সাংগঠনিক শক্তি, সবকিছুতেই ঘুরেফিরে কেবল এ দু’জনারই নাম। মাত্র ক’বছর আগেও বরিশালে আওয়ামী লীগের মাঠের চিত্র অবশ্য এমনটা ছিল না। ওয়ান-ইলেভেনকালীন অনেকটা ফাঁকা মাঠে বরিশালে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের হাতে। পরে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতায় সেই অবস্থান পাকাপোক্ত করেন তিনি। গড়ে তোলেন নিজস্ব শক্ত বলয়। নিজের মতো করে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের কমিটিও গঠন করেন হিরন। প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় হিরনের মৃত্যুর পর অবশ্য দ্রুতই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। হিরনের আদর্শ রক্ষা আর অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হন তারই হাতে গড়া অন্য নেতারা। কেবল ব্যর্থ হন বললে ভুল হবে, তারা গিয়ে ভিড় জমান মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নামা হাসানাতপুত্র যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য সাদিক আবদুল্লাহর কাছে। হিরনের হাতে গড়া ৩০টি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মধ্যে ২৮টির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রে চিঠি দেন সাদিককে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করতে। পাশাপাশি মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিজেকে কঠিনভাবে সম্পৃক্ত এবং সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে থাকেন সাদিকও। এর ফল হাতেনাতে সুফল পেয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ঘোষিত মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে তাকে। হিরন অনুসারীদের অস্তিত্বের কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন তারই স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ। হিরনের মৃত্যুতে খালি হওয়া বরিশাল সদর আসনে দলের মনোনয়নে এমপি হলেও স্বামীর রাজনৈতিক ধারার বিপরীতে গিয়ে হাত মেলান হাসানাত আবদল্লাহর সঙ্গে। মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সুসংহত হয় সাদিকের। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র হিসেবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরও এখানে আওয়ামী লীগ বলতে ঘুরেফিরে আসতে শুরু করে কেবল সাদিক আবদুল্লাহর নাম। এমনকি মহানগরের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও হয়ে পড়েন গৌণ। এখানে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নসহ সব ক্ষেত্রে অনেকটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন সাদেক। সর্বশেষ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে তাকে একক প্রার্থী হিসেবে নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত পর্যন্ত হয়েছে দলে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, ‘যোগ্যতাই একটি মানুষের ওপরে ওঠা এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি। সাদিকের সেই যোগ্যতা আছে। তবে সে এককভাবে আওয়ামী লীগের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এটা ঠিক নয়। দলীয় সব কর্মকাণ্ডে সে আমাদের পরামর্শ নেয়। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বাইরে কিছুই করে না। তাছাড়া তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যে আরও সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হয়েছে সেটা তো মিথ্যা নয়।’ এ ব্যাপারে সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, ‘উত্তরাধিকারসূত্রে আমার শিরা-উপশিরায় আওয়ামী লীগের রক্ত বহমান। আমি যা করি তা আওয়ামী লীগের জন্য করি। সেক্ষেত্রে কি পেলাম বা কি না পেলাম তা বড় কথা নয়। আমি পরিচ্ছন্ন ধারায় রাজনীতি করতে চাই। আর সেভাবেই চেষ্টা করছি।’ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ওয়ান-ইলেভেনে দেশের বাইরে অবস্থানকালীন ছাড়া আগাগোড়াই দক্ষিণে আওয়ামী লীগের অভিভাবক তিনি। তার প্রমাণও রেখেছেন দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় তার একসময়কার হাতে গড়া নেতাকর্মীদের মাধ্যমে। সেসব নেতাই বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুরো দক্ষিণে। এক হিসাবে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ২৬টি পৌরসভার মধ্যে ১৮টিতেই মেয়র পদে আসীন হাসানাত আবদুল্লাহর অনুসারী। এই ২৬ পৌরসভার একটিতে অবশ্য এখনও নির্বাচন হয়নি। বরিশাল বিভাগে থাকা ৪২টি উপজেলার মধ্যে ৩৭টিতে চেয়ারম্যান পদে আছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এই ৩৭ জনের মধ্যে ২২ জন হাসানাতের অনুসারী। এছাড়া দক্ষিণের ২১ সংসদীয় আসনের মধ্যে যে ১৬টিতে আওয়ামী লীগের এমপি রয়েছেন তাদের ৭ জনই তার ঘনিষ্ঠ। বিভাগের ৬ জেলা পরিষদের ৬ জন চেয়ারম্যানের মধ্যে ৪ জন হাসানাতের অনুসারী।
এসবের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অন্য সেক্টরগুলো হিসাব করলে দক্ষিণের অন্য যে কোনো নেতার চেয়ে সমর্থন প্রশ্নে তৃণমূলে অনেক বেশি শক্ত অবস্থানে রয়েছেন হাসানাত আবদুল্লাহ। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিভিন্ন জেলার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা যুগান্তরকে জানান, দক্ষিণের ৬ জেলায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা। কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন মন্ত্রী এমপির সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু তারা কেউই এভাবে পুরো দক্ষিণ নিয়ে মাথা ঘামান না। কেউ কেউ অবশ্য হাসানাত আবদুল্লাহর এসব কর্মকাণ্ডকে পুরো দক্ষিণে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার একক আধিপত্য বিস্তারের কৌশল হিসেবে ভাবেন। তাদের মতে, বরিশাল বিভাগের প্রত্যেকটি এলাকায় নিজের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেই এসব করেন তিনি। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন হাসানাত আবদুল্লাহ। বর্তমানে তিনি আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা যেমন তার অনুসারী হিসেবে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি তেমনি পুরো বরিশালেই ছড়িয়ে আছে তার অনুসারী নেতাকর্মী। তাছাড়া রাজনৈতিক কর্মী তৈরির সূতিকাগার বরিশাল বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে যারা বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন তারাও কোনো না কোনোভাবে পেয়েছেন হাসানাত আবদুল্লাহর সান্নিধ্য। এলাকাভিত্তিক রাজনীতি প্রশ্নে তারাই এখন যার যার এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের। সেই হিসেবে পুরো দক্ষিণে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর শ্রদ্ধার আসন তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সঙ্গে হাত মেলানো প্রসঙ্গে হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ যুগান্তরকে বলেন, তিনি আমার পিতৃতুল্য বড় ভাই এবং রাজনৈতিক অভিভাবক। আমি তার পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা নিয়ে কাজ করি। হিরনের সঙ্গে হাসানাতের দূরত্ব প্রসঙ্গে জেবুন্নেসা বলেন, আমি রাজনীতিতে নতুন। আগে আমার স্বামীর সঙ্গে কী ছিল না ছিল তা আমার জানা নেই।

No comments

Powered by Blogger.