চৌহালী শিক্ষা অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না

সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে। শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা দালাল চক্রের যোগসাজসে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ভুয়া চিঠি দেখিয়ে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা বলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছে। এছাড়া স্লীপ প্রকল্প, স্কুল মেরামত, বদলি, অবসর, বকেয়া বেতন-ভাতাসহ কোন কাজই ঘুষ ছাড়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দালাল চক্রের মাধ্যমে নানা কৌশলে চরাঞ্চলের শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে শিক্ষকদের মাঝে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, যমুনার চরাঞ্চল অধ্যুষিত চৌহালী উপজেলায় ১২৮টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে প্রায় ৭৫১জন শিক্ষক/শিক্ষিকা ও প্রায় ৩২হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়ে অন্যত্র সড়িয়ে নেয়া হয়েছে। বিদ্যালয় গুলোতে কোন রকম ঘর তুলে রোধ-বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে পাঠদান করানো হচ্ছে। চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কমোলমতি শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বর্ষায় নৌকা ও শুস্ক মৌসুমে একমাত্র পায়ে হেটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতো কষ্টের পরও শিক্ষা অফিসের নিয়োগকৃত একটি শক্তিশালী দালাল চক্রের কাছে শিক্ষকরা জিম্মি হয়ে আছেন।
তাদের নানা অজুহাতে উৎকোচ গুনতে হয় চরাঞ্চলের সাধারন শিক্ষকদের। অভিযোগে জানা যায়, শিক্ষা অফিসের কম্পিউটার অপারেটর ( অফিস সহকারীর দায়িত্ব পালন করে) আব্দুল মালেক নিজ এলাকা চৌহালীতে প্রায় এক যুগ ধরে কর্মরত থাকার সুবাদে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার যোগসাজশে আব্দুল মালেক ও স্কুুল ফাঁকি দেয়া পুখুরিয়া কোদালিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দালাল চক্র শিক্ষা অফিসকে ঘুষ দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিনত করেছে। এদের চাহিদা মতো উৎকোচ না দিলে ফাইল মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চরাঞ্চলের শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের আশ্বাসে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ভুয়া স্বারক ও চিঠি পত্র প্রস্তুত করে চৌহালীতে ১৯টি নতুন বেসরকরী প্রাথমিক বিদ্যলয় সৃষ্টিতে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারী তারিখের পূর্বের ডেড দিয়ে অখ্যাত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। যেনতেন ঘর তুলে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে ৪ জন করে শিক্ষক নিয়োগ ও জাতীয় করনের কথা বলে ওই চক্রটি প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই সিন্ডিকেট চক্রের মুনছুর আলী (প্রাক্তন শিক্ষক) ও মশিউরের (সহকারী শিক্ষক) সাথে উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যোগসাজস রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা অফিসে জনবল সঙ্কটের কারণে মশিউরকে দিয়ে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো হয়। তবে দালাল চক্রের বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তোভোগী কয়েকজন শিক্ষক জানান, শ্লিপ প্রকল্পের টাকা উত্তোলন পরবর্তী শিক্ষা অফিসে ভ্যাট ট্যাক্স ছাড়াও ৩ হাজার করে টাকা দিতে হয়েছে। আবার বিল ভাউচার পাশ করানোর সময় দিতে হয় দেড় হাজার করে টাকা। সে কারনে শ্লিপ প্রকল্পে কাঙ্খিত কাজ হয় না।
নাম মাত্র কিছু উপকরন কিনে বিল ভাউচার করে জমা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয়করণের আওতায় উপজেলার ২০ জন পুল শিক্ষক ও ৯০ জন প্যানেল শিক্ষকের যোগদানের সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নিকট থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার করে প্রায় ৩ লাখ টাকা, নব সরকারী বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ জন শিক্ষকের নিকট থেকে টাইমস্কেল বাবদ ৩ হাজার করে দেড় লক্ষ টাকা, মেডিকেল ছুটি পাশ করাতে নিচ্ছে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা, শ্রান্তি বিনোদনের বিল তুলতে প্রতি শিক্ষকের নিকট থেকে ১ হাজার করে টাকা উৎকোচ নেয়া হয়। এছাড়া প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা ব্যয়ে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় মেরামত-সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এদিকে উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়ের অফিস সহকারী আব্দুল মালেক চরাঞ্চলে কর্মরত শিক্ষকদের সুবিধামতো স্কুলে বদলিতে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা এবং পেনশনের টাকা উত্তেলনের কাগজ পত্র তৈরীতে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা করে উৎকোচ আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে অফিস সহকারী আব্দুল মালেকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা অব্ররিশ বাবু চরাঞ্চলে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠায় ঘুষ বাণিজ্যের সাথে নিজে জড়িত নয় দাবি করে এ বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। চৌহালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর ফিরোজ বলেন, অনিয়ম দুর্নীতি আমি পছন্দ করি না। চৌহালীতে যোগদানের পর থেকে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং রয়েছে। মশিউর একটু বেশি অফিসে ঘোরাঘুরি করে তাই অনেকেই সহ্য করতে পারে না। তবে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা বলে টাকা আদায়ের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। সার্বিক বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দীক মোঃ ইউসুফ রেজা মোবাইল ফোনে জানান, আমি কোন অনিয়ম দুর্নীতিকে সমর্থন বা প্রশ্রয় দেই না। চৌহালী উপজেলা শিক্ষা অফিস ও একটি চক্র নতুন ১৯টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সৃষ্টিতে মন্ত্রনালয়ের কিছু চিঠি পত্র আমার কার্যালয়ে পাঠিয়ে সুপারিশের জন্য তদবির শুরু করে। এগুলো আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় আমি আবার ওই চিঠি যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রনালয়ের প্রেরণ করি। সাত দিন পরে প্রাথমিক বিদ্যালয় অধিশাখা-১ হতে যুগ্ম সচিব সাক্ষরিত পত্রে জানতে পারি নতুন বিদ্যালয় সৃষ্টিতে যে কাগজ পত্র জমা দেয়া হয়েছে সেগুলো ভুয়া ও জাল। এরপর ওই স্কুলগুলোর নাম মন্ত্রনালয়ে পাঠাইনি। এছাড়া শিক্ষা অফিসে অনিয়ম, দুর্নীতি ও কিছু শিক্ষক স্কুল ফাঁকি দিয়ে অফিসে তদবিরের বিষয় গুলো তদন্ত করে অভিযোগের প্রমান পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.