‘রুম পার্টি’তে সর্বনাশ

রাজধানীর বনানীতে ধর্ষিত দুই তরুণীকে গভীর রাতে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে ‘রুম পার্টি’তে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। গভীর রাতের ওই বিশেষ পার্টিতেই তাদের সর্বনাশ হয়। রাজধানীতে রুম পার্টির নামের এক ধরনের উচ্ছৃঙ্খল অনুষ্ঠান চলে বিভিন্ন অভিজাত হোটেলসহ বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। এতে অংশ নেয় বিত্তশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী দুই তরুণী এ ধরনের পার্টিতে লালসার শিকার হন। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাতভর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় তাদের ওপর। ঘটনার পর সামাজিক মর্যাদার ভয়ে তারা দীর্ঘ সময় মুখ খোলেননি। তবে ধর্ষণকারীদের অব্যাহত হুমকির মুখে তারা বাধ্য হয়ে থানায় প্রথমে অভিযোগ পরে মামলা করেন। তবে ঘটনার এতদিন পর ধর্ষণের অভিযোগ মানতে নারাজ অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে ধর্ষণ মামলাটি করা হয়েছে। অভিযোগকারী তরুণীরা স্বেচ্ছায় গভীর রাতে সেই হোটেলে যান। সেখানে অনৈতিক ‘কোনো কিছু’ হয়ে থাকলে তা ছেলেমেয়ে উভয়ের সম্মতিতেই হয়েছে। সেখানে ধর্ষণের অভিযোগ সঠিক নয়।
এজাহারে সেই রাতের বর্ণনা
 মামলার এজাহারে বাদী বলেন, ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন ২৯ মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত তার এক বান্ধবী ও দুই ছেলে বন্ধুকে গুলশানের রেইনট্রি নামের একটি হোটেলে অস্ত্রের মুখে আটকে রাখা হয়। একপর্যায়ে তাকে ও তার বান্ধবীকে আসামিরা জোর করে হোটেলের রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের মদ পান করানোর পর এক নম্বর আসামি সাফাত আহমেদ তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা অপর বান্ধবীকেও একাধিকবার ধর্ষণ করে দুই নম্বর আসামি নাঈম আশরাফ। এজাহারে আরও বলা হয়, তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফকে তারা গত ২ বছর ধরে চিনতেন। তার মাধ্যমেই এক ও দুই নম্বর আসামির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। ২৮ মার্চ এক নম্বর আসামির জন্মদিন উপলক্ষে সাদমান সাকিফ তাদের দাওয়াত দেন। অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য তাদের কাছে গাড়ি চালক বিল্লাল ও বডিগার্ড পাঠানো হয়। ওই গাড়িতে তারা গুলশানের রেইনট্রি হোটেলে যান। অনুষ্ঠান সম্পর্কে তাদের বলা হয়েছিল হোটেলের ছাদে অনেক বড় অনুষ্ঠান হবে। সেখানে অনেক লোকজন থাকবে। কিন্তু তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিন্ন দৃশ্য দেখেন।
তারা সেখানে রুম পার্টির আয়োজন দেখতে পান। তাছাড়া হোটেলে গিয়ে তারা আরও দুই তরুণীকে দেখতে পান। এজাহারে বলা হয়, ওই দুই তরুণীকে নিয়ে সাফাত ও নাঈম বার বার হোটেলের ছাদ থেকে নিচে নামিয়ে যাচ্ছিলেন। এসব দেখে অনুষ্ঠানের পরিস্থিতি ভালো মনে হয়নি তাদের। একপর্যায়ে সেখান থেকে তারা চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। এতে আসামিরা তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। আসামি সাফাত ও নাঈম তাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়। তাদের বেদম মারধর করা হয়। একপর্যায়ে দুই তরুণীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে আসামিরা। শুধু তাই নয়। ধর্ষণের সময় এক নম্বর আসামি সাফাতের গাড়ি চালক বিল্লালকে দিয়ে ঘটনার ভিডি চিত্র ধারণ করা হয়। হোটেলে নির্যাতিত হওয়ার পর ঘটনা গোপন রাখার জন্য তাদের ওপর চাপ দেয়া হয়। বিশেষ করে সাফাত তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী পাঠিয়ে তাদের নানা ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে রাখে। এ কারণে তাদের মামলা করতে দেরি হয়।
আসামিদের পরিচয়
বনানী থানায় পাঁচ যুবককে আসামি করে দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলার হাতে লেখা এজাহারের একটি কপি যুগান্তরের হাতে এসেছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হল- সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ, তাদের গাড়ি চালক বিল্লাল ও সাফাতের দেহরক্ষী (নাম অজ্ঞাত)। জানা গেছে, মামলার এক নম্বর আসামি সাফাত আহমেদের পিতার নাম দিলদার আহমেদ সেলিম। তিনি দেশের শীর্ষ স্থানীয় স্বর্ণলঙ্কার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আপন জুয়েলার্সের মালিক। এছাড়া দুই নম্বর আসামি নাঈম আশরাফ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত। তার বিস্তারিত পরিচয় ও পরিবারের সদস্যদের নাম পাওয়া যায়নি। তবে তিনি রাজধানীর মিরপুর এলাকায় থাকেন বলে জানা গেছে।
মামলার তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফের বাবার নাম মোহাম্মদ ওরফে জনি। তিনি রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডে অবস্থিত রেহনাম রেগনাম সেন্টারের মালিক। অভিযোগের বিষয়ে জানতে নাঈম আশরাফের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ইন্টারেনেটে কথা বলার অ্যাপস ভাইবারে তার সঙ্গে কথা হয়। এ সময় নাঈম ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কায় তিনি মিডিয়ার সামনে আসছেন না। তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না। সেদিন রাতে যা কিছু হয়েছে তার সবকিছু সমঝোতার ভিত্তিতেই হয়েছে।
পরিবারের বক্তব্য
ধর্ষণের অভিযোগকারী দুই তরুণী রাজধানীর দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের একজন নিকেতন আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাটে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে মেসে থাকেন। নিকেতন এলাকাতেই আরেকজন ভাড়া থাকেন তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। ধর্ষণ মামলার বিষয়ে কথা বলার জন্য রোববার এ দুই শিক্ষার্থীর বাসায় গেলে উভয় পরিবারের সদস্যরা জানান, বিষয়টি মিডিয়ায় আসুক- এটি তারা চান না। কারণ এতে করে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। এক তরুণীর মা জানান, তার মেয়ে ঘটনার দিন ধর্ষণের শিকার হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, আমার মেয়ে এমনিতে পড়াশোনা নিয়েই থাকে। তবে অস্বীকার করব না সে একটু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করে। ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, মার্চের কোনো একদিন সে আমাকে এসে জানাল, তার এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টি আছে। সেখানে দাওয়াত খেতে যাবে। রাতে নাও ফিরতে পারে।
পরদিন ভোরে মেয়ে ঠিকঠাক বাসায় এসেছে। ধর্ষণ বা তার সঙ্গে কেউ খারাপ আচরণ করেছে- এমন কোনো কথা সে বলেনি। আরেক তরুণীর মা বনানী থানায় মামলা দায়েরের পর ঢাকায় এসেছেন। রোববার দুপুরে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ধর্ষণ মামলার বিষয়ে আমার মেয়ে আমাকে কিছুই জানায়নি। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেয়ে ভার্সিটি থেকে ফিরলে আমি মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করব। প্রভাবশালীদের কোনো পক্ষের চাপের কারণে আপনারা ভীত কিনা জানতে চাইলে এক তরুণীর মা বলেন, আমরা সাধারণ ফ্যামিলি। মেয়েটার বিয়েশাদি দিতে হবে। তাই এখন এমন কিছু বলব না যাতে আমরা আরও বিপদে পড়ি। অপর মেয়ের মা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। যদি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে তবে আমরা ন্যায্য বিচার চাই। তবে অযথা কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়।
ধর্ষণ নয় সমঝোতা
এদিকে ধর্ষণের এ অভিযোগ মোটেও আমলে নিতে রাজি নন আসামিদের পরিবারের সদস্যরা। এক নম্বর আসামি জুয়েলারি ব্যবসায়ী দিলদার আহমেদ সেলিম যুগান্তরকে জানান, তার ছেলে নিরপরাধ। ছেলেকে ব্ল্যাকমেইল করতে ধর্ষণ মামলা করা হয়েছে। ৮ মার্চ আসলে কী ঘটেছিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে দিলদার আহমেদ বলেন, সেদিন সাফাতের জন্মদিন ছিল। রেইনট্রি হোটেলটি আমাদের পরিচিত। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে তার জন্মদিন উদযাপনের কথা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পার্টিতে তার বান্ধবীরা যোগ দিয়ে থাকতে পারে। সেখানে বান্ধবীদের সঙ্গে যদি কিছু হয় তবে তা নিশ্চয় সমঝোতার ভিত্তিতেই হয়েছে। ধর্ষণের প্রশ্নই ওঠে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার ছেলে ঢাকার নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে। কিন্তু ২ বছর আগে তার জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। পিয়াসা নামে এক টিভি মডেলের সঙ্গে সাফাতের প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু এ সম্পর্কের কথা তারা কেউ জানতেন না।
পরিবারের সদস্যদের কাছে গোপন রেখে তার ছেলে পিয়াসাকে বিয়েও করে। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ে মেনে না নিলে সাফাত দুই মাস আগে পিয়াসাকে তালাক দেয়। পিয়াসার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকেই মূলত তার ছেলেকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগ দেয়ার সময় পিয়াসা নিজেই থানায় উপস্থিত ছিল। তাছাড়া মামলা দায়েরের পর অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পিয়াসা তার মোবাইল ফোনে মেসেজও পাঠিয়েছে। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে। আপন জুয়েলার্সের কর্মকর্তা ডা. দৌলা যুগান্তরকে বলেন, আসলে এ ধর্ষণ মামলার পেছনে পিয়াসার হাত রয়েছে। সে-ই পেছন থেকে সব কলকাঠি নাড়ছে। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা যুগান্তরকে বলেন, এখানে ব্যক্তিগত শত্রুতা নয়। ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী তার পূর্বপরিচিত হওয়ায় তিনি তাদের সঙ্গে থানায় গিয়েছিলেন। ঘটনার রাতে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী যে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণের শিকার হন তার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.