বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভুবন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যতটা কবি তার চেয়ে তিনি অনেক বড় পণ্ডিত এবং দার্শনিক। শিক্ষিত বাঙালির ভাবমানসই কেবল তিনি নির্মাণ করেননি, তাদেরকে সত্যিকার অর্থে বাঙালি করেছেন, শুদ্ধ এবং পরিশীলিত বাংলায় কথা বলতে শিখিয়েছেন- বাংলা গদ্যরীতিতে তিনি অসামান্য পরিবর্তন এনেছেন। তিনি যেমন বহু বাংলা শব্দ নির্মাণ করেছেন, তেমনি তার প্রয়োগরীতি উদ্ভাবন করেছেন। তিনিই বাঙ্গলা ও বাঙ্গাল-চারমাত্রার বানান দুটো বর্জন করতে বলেছেন। তবে ভাষা ব্যবহার এবং জীবনের অন্য ক্ষেত্রে তিনি পাণ্ডিত্যের চেয়ে রচনার প্রসাদ গুণ, তার গ্রহণযোগ্যতা- সামগ্রিক সত্যনিষ্ঠা ও সততাকে বেশি মূল্য দিয়েছেন। অহংবোধকে যে তিনি সব সময় অতিক্রম করতে পেরেছেন এমন নয়। তাই প্রকাশক তার শব্দের বানান সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেছেন ‘ওটাই থাকবে’। আবার প্রদোষ শব্দ নিয়ে বিতণ্ডা হলে তিনি অতি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘অজ্ঞতা ও অনবধানতায় স্বকৃত ও অন্যকৃত দোষে অনেক ভুল আমার লেখায় থেকে গেছে। মেনে নিতে কখনও কুণ্ঠিত হইনে। পাণ্ডিত্যের অভাব এবং অন্য অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও সমাদরের যোগ্য যদি কোনো গুণ আমার রচনায় উদবৃত্ত থাকে তবে সেইটের পরেই আমার একমাত্র ভরসা : নির্ভুলতার পরে নয়।’ রবীন্দ্রনাথ সেই ব্যক্তি যিনি বাংলার বাঙালিকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিয়েও জাতীয় সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বহুজাতিক স্রোতধারায় নিজেকে বিলীন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। সে অর্থে তিনি পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক। তিনি যেমন টলস্টয়ের সঙ্গে সেতুবন্ধন স্থাপন করেছেন, তেমনি আর্জেন্টিনার ওকাপ্পোকে আপন করে নিয়েছেন কিংবা ওকাপ্পো কবি গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছিলেন। তিনি যেমন এজরাপাউন্ড, ইয়েটস ও রদেনস্টেইন এবং টিএস ইলিয়টের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করেছেন, তেমনি মুলার এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রভাবনা এবং সভ্যতার সংকট নিয়ে কথকতায় ডুবে গেছেন। বাংলার কবি শ্রী অক্ষয়চন্দ্র যখন কবি বিদ্যাপতিকে সমকালীন সাহিত্যের সমান্তরালে আনতে চেয়েছেন বা তার শ্লোকের গূঢ় ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, সে সময়, রবীন্দ্রনাথ চর্যাপদ এবং মধ্যযুগের সাহিত্য আত্মস্থ করে নিয়েছেন। বিদ্যাপতি, শ্রী জয়দেব, চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস রচিত বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব, ভাবনা, শব্দ, সুর অনেক বাক্য উচ্চারিত হয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। পাসরি (ভুলে যাওয়া) শব্দটি রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া কেবল বৈষ্ণব পদাবলীতে পেয়েছি। যেমন পেয়েছি পেখলুঁ (দেখলুম) শব্দটি। পদাবলী এবং প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য, বিশেষ করে কালিদাস রচনা এবং তামিল সাহিত্যে প্রকাশিত প্রেম, বিরহ, অভিসার, আকুলতা, মান, আক্ষেপ, প্রতীক্ষা এবং সার্বিক নিবেদন রবিন্দ্রনাথের নানা কবিতায় নানা আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়েছে। তার কবিতা ও দর্শনে বৈষ্ণববাদ, চৈতন্যচিন্তা, সুফিবাদ এবং লালনসহ আঞ্চলিক গীতি কবিতার ভাব ও দর্শনের প্রভাব প্রবল। সর্বোপরি তার রচনায় রয়েছে ভগবদ্গীতা এবং নানা বেদের নানা মুনির দর্শন ও চিন্তার প্রকাশ। তিনি নানা ধর্মচিন্তা, আধুনিক দর্শন এবং প্রাচ্যের মুনি ঋষিদের ভাবনাকে অপূর্বভাবে সমন্বিত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি পাঠ করেছেন রক্ষণশীল বৈদিক পণ্ডিত শাণ্ডিল্য এবং আত্মনবাদী উদ্দালককে। সংস্কৃত বৈয়াকরণিক পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী সম্ভবতঃ তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। তিনি যেমন বাঙালিকে বাংলা শিখিয়েছেন তেমনি, নতুন শব্দ এবং ভাবনা-চিন্তার সন্ধান দিয়েছেন। কবিতা, নাটক এবং গানে তিনি প্রচলিত ধারা এবং পাশ্চাত্য রীতির সমন্বয় করেছেন। মাটির গান, ঘাটের গান, আখড়ার গান, নৈবদ্যের গান, প্রার্থনা, মন্ত্র, স্তোত্র, দেশের গান বিদেশের গান, বিশেষ করে আইরিশ গান ও নৃত্য, মনিপুরি নৃত্য, ওডিসা নৃত্য, পাহাড়ের নৃত্য, সমতলের নৃত্য, ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং সনাতন মন্দিরনৃত্য, সবকিছুর মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি যেমন Inverted-কে অন্তঃপাতিত বলেছেন, Permission-কে অনুজ্ঞা, Association-কে অনুষদ বলেছেন তেমনি Caste-কে জাত, Race-কে জাতি, Nation-কে রাষ্ট্রজাতি, People-কে জনসমূহ, Population-কে প্রজন বলেছেন। কাজ ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে তিনি জ্ঞান ও মহিমাতে (Sublimity) ডুবে যান। তারপরও তিনি যখন Apathy i বাংলা করেন অনীহা তখন কিছুটা আপত্তি জেগে উঠে। Caste-কে বর্ণ, শ্রেণীবর্ণ বা সম্প্রদায় বললে হয়ত ভালো হতো। এরপরও রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই। তার সমাজ ভাবনা এত বিশাল এবং আন্তরিক ছিল যে তার সঙ্গে বিশ্বের কোনো কবি বা সাহিত্যিকের তুলনা হয় না। তিনি দেশ ও জাতির ভাবমানস পরিবর্তন করে গেছেন। তিনি কেবল ভাবিত হয়ে এবং ভাব প্রকাশ করে ক্ষ্যান্ত হননি। তার মানবকল্যাণ ধারণার সার্থক প্রকাশ হল কালিগ্রাম সমবায় ব্যাংক এবং পতিসরে আধুনিক চাষের প্রচলন। তিনি নারী ও মানবতার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। তিনি বাংলার যে রূপ দেখেছেন, যে দৈন্যদশা দেখেছেন, রোগে-শোকে কাতর কৃষক, রুগ্ন শিশু ও ব্যথাক্লিষ্ট প্রাণীদের দেখেছেন তেমন করে ক’জন এই দেশ, দেশের ব্রাত্যজন ও গণমানুষকে দেখেছেন সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে তারা নানা ধরনের রচনায় রসের অনির্বচনীয়তা নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ‘যুগেযুগে রসের স্বাদ সমান থাকে না-’ এ কথাটি তার অনেক গল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হলেও গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে নয়- গানের বেলায় তো একেবারেই নয়। রবীন্দ্রনাথের গান নিঃসন্দেহে তার শ্রেষ্ঠ অবিনাশী কীর্তি। বাংলা ভাষায় তার অবদান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় বলতে হয়, ‘আমাদের ভাষায় যিনি কবিগুরু এবং যার সমকক্ষ কবি আবহমান ভারতে নেই, তিনিই আমাদের গদ্যরীতির স্রষ্টা।’ বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখেই এ কথাটা বলতে হবে। তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ক্ষেত্রে হয়ত কিছুটা শূন্যতা রয়েছে। কবিতার ভাব ও কথা থেকে বেরিয়ে ভিন্নমায়াজাল সৃষ্টি করে সর্বজনগ্রাহ্য কালজয়ী কাব্যভূমি নির্মাণে তিনি যেন দ্বিধান্বিত ছিলেন। T. S. Eliot রচিত The Waste Land অথবা Little Gidding এ উল্লেখিত- ‘Ash on an old man's sleeve/ Is all the ash the burnt roses leave/ Dust in the air suspended/ Marks the place where a story ended./ Dust inbreathed was a house ... / The death of hope and despair/ This is the death of air.’ চরণগুলোতে জীবন অথবা মৃত্যুর যে ঘ্রাণ তা বিশ্বকবিদের ভাবনার ব্যাপ্তি এবং গভীরতাকে প্রকাশ করে। যখন W.B. Yeats তার Easter 1916-এ বলেন-‘Too long a sacrifice/ Can make a stone of the heart, .../ To murmur name upon name,/ As a mother names her child / When sleep at last has come/ On limbs that had run wild./ What is it but nightfall? / No, no, not night but death;/ Was it needless death after all?’ তখন বিশ্ব কবিতার আন্তর্জাতিক মান সম্পর্কে ধারণা পাই। এই অর্থে কবি তার বোধ ও ভাবনাকে কাব্য রচনায় প্রয়োগ করেছিলেন কিনা তা গবেষণার বিষয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ও চিত্রকলাসহ সংস্কৃতির সব ভুবনে সমভাবে পদচারণা করেছেন। তার চিত্রকলাকে নানা বিচারে মনে হয়েছে অস্থির কবির সমুদ্রসম হৃদয়ের অন্তর্নীহিত চিত্র। তার আত্মপ্রতিকৃতি বা চারকল এচিং কবির মনোজগতের গভীরে প্রোথিত আরেক অধ্যায়কে উন্মোচন করেছে। তার ‘বাংলার ব্যাঘ্র চিত্র’ যাতে কিনা ক্ষীণকায়, রুগ্ন, ভগ্ন একটি ব্যাঘ্র উপস্থাপিত হয়েছে তা তার জীবপ্রেম ও অনুকম্পা না তার নিজস্ব রীতি বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করেছে তা দেখার বিষয়। এ সবকিছুর পরও রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের ঠাকুর। তার চিত্রে রয়েছে এক ধরনের দ্বৈতসত্তা এবং পরাবাস্তববাদ। পিকাসোর জীবনে যুদ্ধ ও নারী যেমন বিপ্লব এনেছিল তেমন অভিজ্ঞতার মাঝে রবীন্দ্রনাথ প্রবেশ করেননি। তিনি রীতি অনুসারী বা রীতিভাঙ্গা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আঁকিয়ে ছিলেন না। এ আলোকে রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্ম ও চিত্রকলা বিচার করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদর্শন, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, বোধ ও মানবতাকে সত্যিকার অর্থে অন্তরে ধারণ করতে পারলেই তাকে পাঠ করা সম্ভব। প্রাচ্যের ভাববাদী দর্শন তথা ধর্মভিত্তিক দর্শনকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপন করে নিয়েছিলেন। বৈদান্তিক দর্শনের সঙ্গে জৈনবাদ এবং সর্ববাদী ধর্ম ও দর্শন তথা সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদের মিশেল তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই দর্শনের সঙ্গে একত্ববাদের সমন্বিত ধারাকে মূল্য দিয়ে তিনি হাফিজ ও খৈয়ামকে পাঠ করেছেন। তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন ব্রহ্ম ধর্মের অন্যতম প্রচারক ও সংঘটক ছিলেন তেমনি হাফিজ ও অন্যান্য সুফি সাধকদের ভক্ত ছিলেন। এর একটা প্রভাব ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর। পূর্ব বঙ্গের বাউল গীতিসহ মন্দিরে মন্দিরে চর্চিত আরাধনা সঙ্গীতগুলো একটি বড় ছাপ রেখেছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর। ভাববাদের বাইরে ‘চার্চ ক্যারল’ কান্ট্রি গান এবং আইরিশ গানেরও প্রভাব রয়েছে তার গানের মাঝে। সুফি সঙ্গীত ও বাউল সঙ্গীতের mysticism-এর সঙ্গে মন্দিরে মন্দিরে চর্চিত ভজন এবং আইরিশ গানের মন্দাক্রান্তা ছন্দগুলো নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার গানে। ভক্তিবাদী এই সব গান ও কবিতা নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানের কথাকে যেমন মূল্য দিয়েছেন তেমনি সুর, স্বর, গানের মাত্রা, অনুষঙ্গী বাজনা ও বাদন নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছেন। গানের মাঝে প্রতিভাসিত রবীন্দ্রনাথই বিশ্বমঞ্চে চিরন্তন হয়ে থাকবে। কবি তার কাব্য রচনায় কালিদাস ও দান্তেকে কতটুকু অনুসরণ করেছেন বা করতে চেয়েছেন, খৈয়াম, হাফিজ বা রুমিকে কতটুকু আত্মস্থ করেছেন, আধুনিক কবিতা রচনায় কতটুকু সার্থক হয়েছেন সেটা গবেষণার বিষয়। আধুনিক কবিতায় তিনি কতটুকু কোলরিজ, ইয়েটস, ইলিয়ট বা রিলকেকে অতিক্রম করেছেন বা করতে পেরেছেন সেটা আলোচনার বিষয়। ছোটগল্প বা উপন্যাসে আদৌ তিনি টলস্টয়, শেখভ, দস্তয়ভস্কি, হার্ডি প্রমুখকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন কিনা তা দেখা প্রয়োজন। এ সব করা প্রয়োজন ভাবাবেগের ঊর্ধ্বে ওঠে। ভক্তিবাদে আচ্ছন্ন না হয়ে নন্দিতজনের জীবন ও কর্মকে সত্যিকার অর্থে মূল্যায়ন করে, ইতিবাচক বিষয়গুলো অন্তরে ধারণ করে, শ্রদ্ধা নিবেদনটি সার্থক করা প্রয়োজন। নিজের অজ্ঞতা, দীনতা ও শূন্যতাকে আড়াল করতেই ভক্তিবাদে সমর্পণ করে অবুঝ মন। অবোধ তার দীনতা, জ্ঞানশূন্যতা, অক্ষমতা ও দুর্বলতার কারণে ভক্তিবাদে আশ্রয় নেয়, ভক্তিরসে ডুবে নিজের কষ্ট ও ব্যর্থতাকে আড়াল করে, এতে পূজক ও পুজিতের জীবন ও কর্মের মূল্য বৃদ্ধি পায় না। রবীন্দ্রনাথের সার্থক মূল্যায়ন এবং তার কর্মের অনুসরণ জাতিকেই সমৃদ্ধ করবে। এতে কবি নিজ গুনে, নিজ স্থানে অধ্যারুড় হবেন- তিনি কখনই হারাবেন না আমাদের হৃদয় থেকে।
ডা. এমএ হাসান : মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাবিষয়ক গবেষক; বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত
dhasan471@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.