আফ্রিকায় বিস্তৃত হচ্ছে চীনের সাম্রাজ্য

আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে মরুভূমির নিকটবর্তী জায়গাটি নামিবিয়ার সকোপমুন্ড। এখানকার শতাব্দীপ্রাচীন দালানগুলো এখনও জার্মান উপনিবেশের চিহ্ন বহন করে চলেছে। তবে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী শহরটির লিবার্টিনা আমিথিলা এভিনিউয়ে বেশ কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়ি ও বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। একমাত্র এই এলাকাটিতেই ঝকঝকে আলো চোখে পড়ে। তবে এই এলাকাটিতে যারা থাকে তারা আফ্রিকান নন, চীনা। প্রতিদিন ভোরে বাড়িগুলো থেকে খাকি ইউনিফর্ম পরে তারা বেরিয়ে আসেন। তারপর একটা জায়গায় জড়ো হন। সবার শেষে যিনি আসেন তিনি ডিলান তেং। ২৯ বছর বয়সী একজন প্রকৌশলী তিনি। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে নামিবিয়ায় আসার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তিনি এটা করে আসছেন। নাস্তার পর সকাল ৬টায় সহকর্মীদের নিয়ে উঠে বসেন বাসে। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি সিজিএন বা চায়না জেনারেল নিউক্লিয়ারে চাকরি করেন তারা। সমগ্র আফ্রিকায় সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর মালিক এই কোম্পানি। প্রায় ১ ঘণ্টা পর বাসটি তার গন্তব্য ইউরেনিয়ামের খনি হুসাব ইউরেনিয়াম মাইনে এসে পৌঁছায়। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউরেনিয়ামের খনি এটি। এখানে ৪.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে কোম্পানিটি। এই খনি থেকে যে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা হবে তা দিয়ে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে এবং পরমাণু অস্ত্রও প্রস্তুত করা যাবে। চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের সিচুয়ান প্রদেশের একটি গ্রামের কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের একজন তেং। হুসাব ইউরেনিয়াম খনির গুরুত্ব সম্পর্কে জানেন। আগামী বছর এই খনি যখন পুরোদমে উৎপাদনে যাবে তখন নামিবিয়ার জিডিপি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে উৎপাদিত ইউরেনিয়ামের পুরোটাই যাবে তেংয়ের নিজের দেশ চীনে। এই ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে পরমাণু বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে চীন। একইসঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে দেশটি। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে চীনের পূর্বাঞ্চলের বেশিরভাগ এখন বায়ুদূষণের কবলে পড়েছে। রাজধানী বেইজিংয়ে বায়ুদূষণের মাত্রা আরও ভয়াবহ। আর তাই তেং তার নিজের ও তার দেশের ভবিষ্যতের জন্য আফ্রিকার নামিবিয়ায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। সকোপমুন্ডের ২৫ মাইল দক্ষিণে ওয়ালাভস উপসাগর। এখানে চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অপর এক কোম্পানি প্রায় ৪০টি বেসবল মাঠের সমান একটি কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করছে। নিকটবর্তী এলাকায় চীনের অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে নতুন হাইওয়ে, শপিংমল, একটি গ্রানাইট ফ্যাক্টরি এবং ৪০০ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি ডিপো। বর্তমানে বিশ্বের প্রত্যেক প্রান্ত থেকে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব অনুভব করা যাচ্ছে। উদীয়মান পরাশক্তি চীন এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলকে তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে নিয়ে এসেছে। ২০০০ সালে মাত্র পাঁচটি দেশ চীনকে তাদের সর্ববৃহৎ ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে গণ্য করত। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত প্রায় ১০০টি দেশ চীনকে তাদের বৃহত্তম ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে গণ্য করে। চীন তার সামরিক ও বাণিজ্য প্রকল্প ক্রমেই সারা বিশ্বে বিস্তৃত করছে। তবে আফ্রিকার দরিদ্র ও প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ দেশগুলোতে তারা বেশিরভাগ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে চীন দেশের বাইরে তার প্রথম সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এছাড়া নাইজেরিয়াতে ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে উচ্চগতি সম্পন্ন রেলপথ এবং ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নিকারাগুয়ার মধ্য দিয়ে একটি অসাধারণ খাল নির্মাণ করছে দেশটি। এছাড়া ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান পলিসির’ অধীনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে অবকাঠামো নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে একসুতোয় বাঁধতে ইতিমধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একসময়ের ‘সিল্ক রুট’ আবার পুনরুজ্জীবিত হবে বলে আশা করছে চীন। চীনের এই প্রকল্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্শাল প্লানকেও ম্লান করে দেবে। আফ্রিকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ১৯৬০-এর দশক থেকে। মাও সেতুং উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘ইয়া, ফেই লা’। এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার আদ্যক্ষর বুঝিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে তানজানিয়া থেকে জাম্বিয়া পর্যন্ত ১১৫৬ কিমি. রেলপথ নির্মাণ করে চীন। এরপর দরিদ্র ওই দেশগুলোর জন্য সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও প্রায় ৩০ বছর ধরে কোনো বড় প্রকল্প ছিল না। ২০০০ সালের পর এই অঞ্চলে নতুন করে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে থাকে চীন। বেইজিং উপলব্ধি করে, তার নিজ দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সচল রাখতে হলে বিদেশি সম্পদ ও মিত্র দরকার। আর এ কারণেই চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলো আফ্রিকা ও এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ শুরু করে। চীনের অগ্রগতি বস্তুত শুরু হয়েছে তখন থেকে যখন পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমতে থাকে এবং বর্তমানে বৈশ্বিক বিভিন্ন চুক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে ওয়াশিংটন। এই সুযোগে বিশ্ব নেতৃত্বের সক্ষমতা প্রদর্শন ও নিজস্ব বহু উদ্যোগ গ্রহণের বহুক্ষেত্র তৈরি হয়েছে চীনের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১২টি শিল্পসমৃদ্ধ দেশের চুক্তি ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে তা বাতিল করেছেন। এই পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে চায় চীন। তারা ইতিমধ্যে বিকল্প চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টতই বাইরে রাখবে। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা নীতি কর্মসূচির পরিচালক ও ‘চায়না গোজ গ্লোবাল’ বইয়ের লেখক ডেভিড শ্যামবগ বলেন, ‘বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু অংশে ট্রাম্প প্রশাসনের অপেক্ষাকৃত অমনোযোগ চীনের জন্য নিশ্চিতভাবেই জায়গা করে দিচ্ছে।’ নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর জামির হোসেন

No comments

Powered by Blogger.