অস্ত্র নিয়েই হোটেলে ঢুকেছিলেন সাফাতরা

রাজধানীর বনানীতে দুই তরুণীকে ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ ও তার গাড়িচালক বিল্লালকে সোমবার রাতে কিছু সময়ের জন্য মুখোমুখি করেছিলেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তখন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিল্লালের কাছে জানতে চান, সেই রাতে তিনি (বিল্লাল) কার নির্দেশে মোবাইল ফোনে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করেছিলেন? এ সময় মুখে কিছু না বলে একই কক্ষে কয়েক হাত দূরে একটি চেয়ারে বসে থাকা সাফাত আহমেদের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করেন বিল্লাল। ওই সময় বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বিল্লালের দিকে তেড়ে যান সাফাত। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেখানে উপস্থিত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে (সাফাত) শান্ত করেন। ২৮ মার্চ বনানীর দি রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলায় আসামি সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল চার এবং বডিগার্ড রহমত আলী ওরফে আবুল কালাম আজাদকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার দুপুরে ধর্ষণের ঘটনায় এজাহারভুক্ত এ দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম লস্কর সোহেল রানার আদালত দুই আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মঙ্গলবার ওই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সাফাতের বাবা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে স্বীকার করেছেন, তিনিও ছেলের মতো নানা ‘অপকর্ম’ করেছেন। তাই তার (সাফাতের বাবা) দ্বারা এ পর্যন্ত কতজন নারী বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন- জিজ্ঞাসাবাদে সেটি জানতে চাইবে পুলিশ। ক্ষতিগ্রস্ত কোনো নারী যদি এ ব্যাপারে নিজ থেকে এগিয়ে আসেন অথবা মামলা করতে চান, সে ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে যাবতীয় সহযোগিতা দেয়া হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার রাতে অস্ত্র নিয়েই হোটেলটিতে (দ্য রেইনট্রি) প্রবেশ করেছিলেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন সাফাতের বডিগার্ড রহমত আলী। এ সময় সাফাত আহমেদ একবার তার কাছ থেকে অস্ত্রটি নিয়ে রুমে গিয়েছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে ফ্রন্ট ডেস্কে অস্ত্র জমা রেখেই সেদিন অতিথিরা ভেতরে ঢুকেছিলেন বলে প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, সোমবার গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই গাড়িচালক বিল্লাল সে রাতের ঘটনার পুরো বর্ণনা দেন। পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিল্লাল ধর্ষণের পুরো ঘটনা মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে স্বীকার করেছেন। ঘটনার রাতে তার মালিক (সাফাত আহমেদ) নিজেই বিল্লালকে ডেকে নেন। এ সময় সাফাত আহমেদ তাকে (বিল্লাল) বাথরুম সংলগ্ন ড্রেসিং রুমে গিয়ে ধর্ষণের চিত্র মোবাইলে ভিডিও করার জন্য বলেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, গাড়িচালক বিল্লাল জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে বলেন, সাফাত এবং তার বন্ধু পলাতক নাঈম আশরাফ (প্রকৃত নাম আবদুল হালিম) যখন দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন, তখন পুরো দৃশ্য সে (বিল্লাল) মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিল। পরে এ ঘটনায় মামলা দায়ের ও মিডিয়ায় একের পর এক খবর ছাপা হতে থাকলে সাফাতের নির্দেশেই তিনি (বিল্লাল) ওই ভিডিও ডিলিট করে দেন। পুলিশ ইতিমধ্যেই গাড়িচালক বিল্লালের ওই মোবাইল ফোনটি জব্দ করেছে। একই সঙ্গে ডিলেট করা ওই ভিডিও পুনরুদ্ধারের জন্য তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে বনানী থানা ও ঘটনাস্থল বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইনট্রি হোটেলের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ জব্দ করে তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে জানান, বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ভিডিও এবং মোবাইল ফোনের মুছে ফেলা তথ্য উদ্ধারেই তারা মনোযোগ দিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই মোবাইল ফোন কোম্পানির কাছে আসামিদের মোবাইল ফোনের কললিস্টসহ বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডিলিট করা হলেও সেটি উদ্ধার করার মতো প্রযুক্তি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইড) কাছে রয়েছে। ফলে মোবাইল ফোন এবং হোটেলের ফুটেজ উদ্ধার সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছেন। আর এ দুটি ফুটেজ পাওয়া গেলেই তা মামলাটি প্রমাণে যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে মনে করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সোমবার রাতে রাজধানীর নবাবপুর রোডের ইব্রাহীম আবাসিক হোটেল থেকে গাড়িচালক বিল্লালকে গ্রেফতার করে র্যাব-১০ এর একটি দল। নাম-পরিচয় গোপন করে সোমবারই ওই হোটেলে ওঠে বিল্লাল।
পরে গোপন খবর পেয়ে র্যাব সদস্যরা বিল্লালকে ওই হোটেল থেকে গ্রেফতার করে। এদিন প্রায় একই সময়ে সাফাতের বডিগার্ড রহমত আলী ওরফে আবুল কালাম আজাদকে গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে একটি শটগান ও ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার বিকাল ৩টার দিকে বিল্লাল হোসেন ও রহমত আলীকে আদালতে হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। রিমান্ড আবেদনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে দেয়া তথ্য উল্লেখ করে আবেদনে বলা হয়, গ্রেফতারকৃতরা মামলাটির আসামি ও প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের কাছ থেকেই সে রাতের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের জামিন না দেয়ার জন্য আবেদন করেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের অতিরিক্ত উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক ইসমত আরা এমি। বডিগার্ড রহমত আলী ওরফে আবুল কালাম আজাদ সোমবার (১৪ মে) থানায় আত্মসমর্পণ করেন দাবি করে আসামিপক্ষের আইনজীবী হেমায়েতউদ্দিন মোল্লা জামিন আবেদনের শুনানিতে বলেন, ‘এই বিবেচনায় তার জামিনের আবেদন মঞ্জুর করা যায়। ঢাকা মহানগর আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু আসামিদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা এবং এখনও একজন আসামি পলাতক আছে জানিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম লস্কর সোহেল রানার আদালত দুই আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রসঙ্গত, ২৮ মার্চ বন্ধুর সঙ্গে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে ধর্ষণের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া দুই তরুণী। ওই ঘটনায় ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ (সিরাজগঞ্জের আবদুল হালিম) ও সাদমান সাকিফসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তারা। শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করা হলে সাফাত আহমেদকে ছয় ও সাদমান সাকিফের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতার সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার ছিল রিমান্ডেও চতুর্থ দিন।

No comments

Powered by Blogger.