রাষ্ট্রের দুই অঙ্গের দূরত্ব প্রসঙ্গে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মধ্যকার সাম্প্রতিক প্রকাশ্য সংলাপকে অনেকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে থাকতে পারেন। তবে এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটা গঠনমূলক সংলাপের দরকার আছে। এর একটা উপযুক্ত অবয়ব বের করতে হবে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে সরকার বিচার বিভাগ–সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে প্রধান বিচারপতিকে কোনো কিছুই অবহিত করা হয়নি।’ কিন্তু আমরা নিশ্চিত নই যে, এই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কী কী। কারণ, বিচার বিভাগ বা সরকার কেউ তা স্পষ্ট করছে না। প্রধান বিচারপতি দাবি করেছেন, ‘সম্পূর্ণ ভুল তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সরকারপ্রধানের কাছে সত্য গোপন করে সিদ্ধান্তগুলো হাসিল করা হয়েছে।’ এটি গুরুতর অভিযোগ। কারণ, সাধারণ জনগণের কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে, এই দাবির সপক্ষে প্রধান বিচারপতির কাছে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। আর সেটা থাকলে ভবিষ্যতে ওই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ হতে পারে। সে জন্য বিচার বিভাগের এটা জানানো উচিত যে এই সিদ্ধান্তগুলো কী কী।
তথ্য গোপন করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের যদি প্রচলিত আইনে শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো ‘সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে দূরত্ব তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত’ ‘একটি মহলের’ পরিচয় জনগণের কাছে পরিষ্কার হতে পারে। অন্যদিকে ‘ক্ষমতা কারও কিন্তু কম নয়’ মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন, তা তিনি কেন বলেছেন, সে বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়ার দাবি রাখে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে বিচার বিভাগ ১৬তম সংশোধনী বাতিলের মতো মাইলফলক রায় দিয়েছেন। মন্ত্রীদের আদালত অবমাননার যে রায় আদালত দিয়েছেন, তাতে অন্য যেকোনো গণতন্ত্রে সরকার চরম বিপদে পড়ত। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় তদন্তের নির্দেশের ঘটনায় সরকারের অস্বস্তি চাপা থাকেনি। প্রধানমন্ত্রী ‘তিন অঙ্গের মধ্যে সমন্বয় সাধন’ বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘প্রতিটি আইন জনস্বার্থে পাস’ করা হয়, আর তা যদি ‘দুজনে বসে’ নাকচ করেন, তাহলে আর ‘কিছুই করার থাকল না’। প্রধানমন্ত্রী মানবেন যে, ইনডেমনিটি বিলসহ সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী জনস্বার্থে এবং আইনসংগতভাবে পাস হয়নি বিবেচনায় ‘দুজনে বসে’ নাকচ করেছেন। আওয়ামী লীগ তাকে স্বাগত জানিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির আগাম সুপারিশ করার অধিকার ছিল না। কিন্তু তিনি কোনো ‘অযাচিত’ সুপারিশ করেছেন বলে সরকারকে কেউ যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বারিত করছে না। সরকারই হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিসের’ ভাস্কর্য স্থাপন ও সরানো নিয়ে মত-দ্বিমত অনেকের মতে অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু যেটা অস্বাভাবিক, সেটা হলো বিরূপতা প্রকাশ করতে গিয়ে সরকার অসতর্ক থেকেছে। প্রতিষ্ঠানের গায়ে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়ে সরকারের অমনোযোগ অস্পষ্ট থাকেনি। এসবই ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দুঃখজনকভাবে উৎসাহিত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে সন্দেহ নেই যে, আদালত এবং সরকারের মধ্যকার টানাপোড়েনের ফলে বিচারব্যবস্থায় জনস্বার্থ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ বিচারবঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি শপথ নেওয়ার পর থেকেই নানা ঘটনায় বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের ‘দূরত্ব’ লক্ষ করা যাচ্ছে। বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বর্তমান প্রধান বিচারপতির কিছু উক্তি সরকারকে বিভিন্ন সময়ে বিব্রত করেছে। আর এই দৃশ্যমান বিব্রত হওয়ার আড়ালে চাপা থাকছে বিচার বিভাগের প্রতি নির্বাহী বিভাগের অবহেলা। অবশ্য প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সরকারের কাছে জিম্মি বলে কখনো কখনো উষ্মা প্রকাশ করলেও প্রায়ই জোরের সঙ্গে বলেছেন যে আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসাও করেছেন তিনি। সেটা কতটা সমীচীন, সেই প্রশ্নও উঠেছে। বহুদিন বাদে আমরা একজন সরব প্রধান বিচারপতি পেয়েছি। তাঁর কোনো কোনো সিদ্ধান্ত বা বক্তব্যের কোনো কোনো অংশ সম্পর্কে মতদ্বৈধতা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি সার্বিকভাবে যা করতে চাইছেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত লড়াই নয়। সরকারের সঙ্গে তাঁর চলমান ‘দূরত্ব’কে নিছক ব্যক্তিগত কোনো বিষয়-আশয় হিসেবে দেখানো হলে সেটা নির্বাহী স্তম্ভকে অন্যায্য সুবিধা দেবে। জনস্বার্থের প্রতিকূলে যাবে।
মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের মতো বিচার বিভাগের সংস্কারে কতগুলো অত্যন্ত মৌলিক বিষয় রয়েছে, যা নির্বাহী বিভাগ কখনো সুরাহা করবে না। আবার কতগুলো সংস্কার রয়েছে, যা প্রধানত বার ও বেঞ্চ করবে। সুপ্রিম কোর্ট বারে বিএনপি তরিকার কমিটির জয়জয়কার হলে কী হবে, তারা স্পিকটি নট হয়ে আছে ও থাকবে। বিএনপির আইনজীবী নেতারা যথারীতি মুখর থাকেন জিয়া পরিবারের ‘রিলিফ’ পাওয়া–না পাওয়া নিয়ে। প্রধান বিচারপতিকে সংবিধান তাঁর একক ইচ্ছায় বেঞ্চ গঠন ও পুনর্গঠনের এখতিয়ার দিয়েছে। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের কোনো বিচারক কখন কোন দায়িত্ব পালন করবেন, তা প্রধান বিচারপতি ঠিক করে দেন। তবে প্রধান বিচারপতির এই এখতিয়ার এককভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয় বলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এর আগে জোরালো মত দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রয়াস প্রধানত অধস্তন আদালত–নির্ভর। তার ওপর তিনি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। উচ্চ আদালতে প্রধান বিচারপতি নির্দিষ্ট সময়ে রায় দেওয়া নিয়ে উদ্যোগী ছিলেন। একটি রায়ে বলা হয়েছে, অনধিক ছয় মাসের মধ্যে রায় দিতে হবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে আর সরব নন বলেই মনে হয়। আলোচিত শৃঙ্খলাবিধিসহ অধস্তন আদালতে বদলি ও পদায়ন নিয়ে সরকারের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির ‘দূরত্ব’ বলে যা অনুমেয়, তার সবটাতেই বিচার বিভাগের সমষ্টিগত মতামত রয়েছে। সরকারের সঙ্গে বড় বিরোধ বিচারক বদলি নিয়ে। গত মাসে এক চিঠিতে অনধিক ১৬ জনের একটি বদলি প্রস্তাবের সবটাই ‘না’ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি একা এই সিদ্ধান্ত নেননি।
নিয়েছে চার বিচারকের সমন্বয়ে করা জিএ কমিটি। শৃঙ্খলাবিধি ফুলকোর্ট ও আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত। প্রধান বিচারপতির স্বপ্নের প্রকল্প ছিল ই-জুডিশিয়ারি চালু করা। সেটা ভেস্তে যেতে বসেছে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন শিকেয় তোলা আছে। জেলা জজ পদে পদোন্নতির বিষয়ে ফুলকোর্টে সর্বসম্মতক্রমে নেওয়া সিদ্ধান্ত সরকার মানতে অপারগ থাকছে। তাই ছয় মাসের বেশি সময় ধরে জেলা জজ নিয়োগে কঠিন অচলাবস্থা চলছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বর্তমান প্রধান বিচারপতি থাকতে এটা আর কাটবে না। দেশের ৪৬ নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে অর্ধেকের বেশি বিচারক পদ খালি। সেখানে হাজার হাজার মামলার বিচার বন্ধ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতে বিচারকসংখ্যা দ্বিগুণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী দুই বছরে ১০০ জনের বেশি জেলা জজ পদ খালি হবে। এটা কখন কীভাবে পূরণ করা হবে, তা কারও জানা নেই। আমরা কথায় কথায় বলি তিনটি অঙ্গ। ড. আলী রীয়াজ অ্যারিস্টটল ও মন্টেস্কুর বরাতে বলেছেন, স্বাধীন ও পৃথক অঙ্গ গড়ার চিন্তাটা ওঁদের। বাজেটের ভিত্তিতে যদি বিচার করি, তবে এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে আমরা ‘অঙ্গ’ বলব কি না? সমগুরুত্বসম্পন্ন ‘অঙ্গ’ মানলে বছরে মাত্র ১৪৬ কোটি টাকা দেওয়া সম্ভব? বার্ষিক মাত্র ১৪৬ কোটি টাকার বাজেট, যা দেশের অনেক সিটি করপোরেশনের বাজেটের চেয়েও কম,
তা দিয়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশের ‘স্বাধীন ও শক্তিশালী’ বিচার বিভাগকে চালানো হচ্ছে। দৈনিক কজলিস্ট (যাতে মামলার তালিকা ছাপা হয়) এখন অনলাইনে চমৎকারভাবে মিলছে। প্রধান বিচারপতি এর মুদ্রণ বন্ধে উদ্যোগী হলে আইনজীবীদের তোপের মুখে পড়েন। যে সরকার গোটা বিচার বিভাগ চালাতে ১৪৬ কোটি টাকা দেয়, সেই সরকারই কজলিস্ট ছাপাতে কার্যত আইনজীবীদের বছরে ভর্তুকি দিয়ে আসছে ৫০ কোটি টাকার বেশি। বারের প্রতিনিধিদল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে নীরব থাকলেও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এ বিষয়ে তারা মানববন্ধনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ক্যাম্পাসে বহুতল বার ভবন হবে, প্রধান বিচারপতি এ জন্য কিছু দরকারি লিখিত শর্ত দিয়েছিলেন। বারের তা মনঃপূত হয়নি। তাই বারের অনেকের কাছে তিনি অজনপ্রিয়। ঐতিহ্যগতভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার প্রশ্নে বারের ভূমিকা সব থেকে অগ্রণী থাকে। কিন্তু সেটা অনুপস্থিত বললে কম বলা হবে। তো এই হচ্ছে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিচারক নিয়োগে ‘কোনো রকম কিছু হলে সেটা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করাটাই ভালো। এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু করণীয় থাকলে নিশ্চয়ই সেটা করা হবে।’
আমরা শেখ হাসিনার এই মনোভাবকে স্বাগত জানাই। তবে সেটা আলোচনার মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য, কারণ প্রধানমন্ত্রী আলবত জানেন রাষ্ট্রপতির এ ক্ষেত্রে কিছু করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং, বিরোধকে বড় করে না তুলে কী করে ‘দূরত্ব’ কমানো যায়, সে বিষয়ে একটা যথা-উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার কোনো একটিকেও প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয় বলে গণ্য করা বা জনগণের চোখে তেমনভাবে প্রতিপন্ন হতে দেওয়ার কোনো চেষ্টার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকতে পারে। এমন কতগুলো বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন দৃশ্যমান, যার দু-একটি বাদে কোনোটিই বর্তমান প্রধান বিচারপতির বর্তমান পদে থাকা–না থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বিষয়গুলো একান্তভাবেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং, সব সমস্যার সমাধানে কেউ যদি ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান প্রধান বিচারপতির অবসরে যাওয়ার দিকে নজর রাখেন, তাহলে সেটা ঠিক হবে না। আর তিনি অবসরে গেলেই যদি একটা সুনসান নীরবতা নেমে আসে, তাহলে তা আমাদের চিন্তামুক্ত নয়, আরও চিন্তাযুক্ত করবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.