বর্তমান অর্থনীতির কিছু সাধারণ চিত্র

রিদিতা ও আফজাল পরিবারের সব মিলিয়ে সদস্য ৫ জন। দু’জনই চাকরি করছেন; মধ্যবিত্তের ভাবনায় পরিচালিত হয়ে আসছে তাদের যাপিত জীবন। মাকে সেবা-যত্ন করা আর ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন ভালোভাবেই। সঞ্চয় প্রবণতা শুরু হয়েছে দেড় দশক আগে যৌথ জীবন চলার শুরু থেকে। প্রথম ভরসা ছিল ব্যাংক; এর পরে ঝুঁকল সঞ্চয়পত্রে। একবার বন্ধু-বান্ধব আর সহকর্মীদের পাল্লায় পড়ে শেয়ারবাজারে পা রেখেছিলেন এই দম্পতি। কিন্তু বেশিদিন লাগেনি, তিলে তিলে করা সঞ্চয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বেনিফিশিয়ারি অ্যাকাউন্টের তলানিতে কয়েকশ’ শেয়ার থাকলেও, তার খোঁজ রাখেন না রিদিতা-আফজাল পরিবার। কোথায় রাখবেন জমানো টাকা- এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবারটি। খোঁজ পেয়েছিলেন সমবায় সমিতির, কিন্তু মন খুব একটা সায় দেয়নি। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, বিভিন্ন সমবায় সমিতির অনিয়ম আর কেলেংকারির খবর। এখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন ভালো ফিন্যান্সিয়াল প্রডাক্ট আর কী আছে। যেখানে আছে আকৃষ্ট হওয়ার মতো মুনাফা আর নিরাপত্তা। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, আর্থিক নিরাপত্তা মিললে কাক্সিক্ষত মুনাফা মিলছে না। আর বাড়তি মুনাফা পেলে, প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে কে ভাববে?
নীতিনির্ধারকদের কি এত সময় আছে, কোথাকার কোন রিদিতা-আফজাল পরিবার কেন সঞ্চয়বিমুখ হয়ে পড়ছেন। সঞ্চয় ও বিনিয়োগের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। কিন্তু সঞ্চয় প্রবণতা বাড়ানোর কোনো ভাবনা আছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলছে, অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হার প্রায় স্থবির। এতে সম্প্রতি উচ্চ ব্যবধান পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই পার্থক্য পুঁজি পাচারকে নির্দেশ করে বলে মনে করে সংস্থাটি। এখন গাণিতিক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যাক। ব্যাংক আমানতের সুদহার এখন তলানিতে। মাসিক সঞ্চয়ী স্কিম ভিন্নতায় ৪ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। আর মেয়াদের আগে ভাঙিয়ে ফেললে মিলবে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ। তবে মেয়াদি আমানতে ৬ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এই সুদের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কর ও অন্যান্য সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়া হয়। সেখানেও চলে যায় বেশ টাকা। গেল ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতের আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। অথচ ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০১৩ সালের ওই সুদহার অপরিবর্তিত থাকলে বর্তমানে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে পরিমাণ আমানত জমা রয়েছে তার বিপরীতে এখন যে পরিমাণ সুদ বা মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে তার থেকে আরও ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি সুদ পেত আমানতকারীরা। সঞ্চয়পত্র কিনে একটু বেশি মুনাফা মিলছে। তবে যারা মাসে মাসে কিছু কিছু টাকা সঞ্চয় করতে চেষ্টা করছে, তাদের বিনিয়োগের পথ অনেকটা সংকুচিত হয়ে এসেছে। সঞ্চয়পত্রে এক লাখ টাকার কম বিনিয়োগ করা যায় না। তাই বাধ্য হয়েই ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের। ব্যাংকের সুদহারে সন্তুষ্ট না থাকায় অনেকেই এখন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকছে।
শেয়ারবাজারের প্রতি এখনও পুরোপুরি আস্থা ফিরে আসেনি। অনেকেই একটু বাড়তি মুনাফার আশায় সমবায়ে টাকা খাটাচ্ছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ না করার জন্য সতর্কীকরণ বিজ্ঞাপনও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতের বিপরীতে দেয়া সুদহারের তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। এতে ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় মূল অর্থও কমে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাজারে কি বিনিয়োগ আকর্ষণে কোনো ফিন্যান্সিয়াল প্রডাক্ট থাকবে না? কিন্তু কারা আনবে? ব্যাংক, বীমা, ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠান, বন্ড ম্যানেজার, লিজিং কোম্পানি, সমবায় সমিতিরই আনার কথা। কিন্তু তেমন উদ্যোগ নেই কেন? বিষয়টি ভাবার দাবি রাখে। প্রডাক্ট ডিজাইনেও আনা প্রয়োজন নতুনত্ব। ব্যাংকিং খাত তো এখন খেলাপি ঋণের ভারে অনেকটাই নুয়ে পড়েছে। সরকারি ব্যাংকের অবস্থা বেশ নাজুক। ক্রমবর্ধমান হারে খেলাপি ঋণের কারণে নিজেদের মূলধনও খেয়ে ফেলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। মূলধনের এ ঘাটতি পূরণে গত পাঁচ বছরেই সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার জোগান দিয়েছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা জোগান দিলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে সরকারের কাছে ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূলধন জোগান চেয়ে আবেদন এসেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি ডাটাবেজে রক্ষিত ঋণ তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়,
গেল নভেম্বরে ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা কোম্পানির সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১৩ হাজার ৫৩২। অথচ বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের বাজার প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার। অর্থাৎ যে টাকা ব্যাংক আদায় করতে পারছে না, সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে কোটি ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীকে অর্থের যোগ দিয়ে আসছে মাইক্রো ফাইন্যান্স ইন্সটিটিউট- এমএফআইগুলো। বীমা খাতের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এখনও তৈরি হয়নি। উদ্যোক্তারা বীমা করেও যথাসময়ে সেবা পাচ্ছে না। এ নিয়ে দফায় দফায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করতে হচ্ছে। এমন বীমা কোম্পানিও রয়েছে, যারা বলছে, সম্পদ বিক্রি ছাড়া গ্রাহকের দায় মেটাতে পারবে না। সাধারণ বীমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটলেও, জীবন বীমায় আছে অন্য ধরনের বিড়ম্বনা। মাঠ পর্যায়ে সবল তদারকি না থাকায় দাবি পরিশোধে গড়িমসির অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে ভালো যে কোম্পানি নেই, তা কিন্তু নয়। মন্দের আধিক্যে ভালো কোম্পানির সাফল্য নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়ছেন অনেকে। ‘Combing social and financial performance: A paradox’ নামে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছিল ২০১১ সালের গ্লোবাল মাইক্রোক্রেডিট সামিটে। ওই প্রতিবেদন বলছে, বেশকিছু ক্ষুদ্র অর্থায়নের সংস্থায় ব্যাপক হারে গ্রাহক ড্রপ আউট হচ্ছে। বাড়ছে খেলাপিও। এ জন্যে প্রডাক্ট ডিজাইনে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ উঠে আসে। বলা হয়, গ্রাহকদের ভাবনার প্রতিফলন না থাকা প্রডাক্টে জটিলতা তৈরি হয়। কোস্টট্রাস্টসহ বেশ কয়েকটি এমএফআই অবশ্য দাবি করে আসছে, তৃণমূলের ভাবনা প্রতিফলিত হচ্ছে প্রডাক্ট তৈরিতে। তবে যে কোনো ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নির্ভর করে তার মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ফাইন্যান্সিয়াল প্রডাক্টের ওপর। তবে নিরন্তর পথযাত্রায় মানতে হবে পরিপালনীয় শর্ত, প্রতিযোগিতা আর ব্যবসা মডেলের নিয়ত পরিবর্তন। আর প্রযুক্তির স্রোতে গা তো ভাসাতেই হবে। তবে অনেক সময়ই অতি মুনাফার লোভে অসুস্থ ও অনৈতিক চর্চা উৎসাহিত হচ্ছে। শুধু ব্যাংকগুলোর মধ্যেই নয়, বরং ব্যাংক বনাম অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও হচ্ছে।
আর্থিক খাতে এখন নিদারুণভাবেই দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের শুধু পুরনো বা প্রচলিত সেবা দিলেই চলে না, নিত্যনতুন পণ্যসেবাও প্রবর্তন করতে হয়। সংখ্যা বাড়লেও নতুন ব্যাংকগুলো গতানুগতিকভাবে কাজ করছে। এসব নতুন ব্যাংক পুরনো ব্যাংকের মতোই টাকাওয়ালাদের ঋণ দিচ্ছে। তারা নতুন পণ্য ও সেবা এনে ব্যাংকিংয়ের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে আওতায় আনার দিকে মনোযোগী নয়। আর এমএফআইগুলো নতুন প্রডাক্টের ক্ষেত্রে খুব একটা বিকশিত হতে পারছে না। বলছে, আইনি জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে সামনে আরও সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। বলা হচ্ছে, সদস্যদের বাইরে থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করতে পারলে দরিদ্র মানুষকে কম সুদে অর্থের জোগান দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে প্রায় চার দশকের পথচলায় বেশ অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে এসব এমএফআই। এ জন্য বাড়তি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, কাজাখস্তান, সুদান বলিভিয়াসহ অনেক দেশই এ ধরনের সঞ্চয় সংগ্রহ করে নতুন নতুন প্রডাক্ট চালু করেছে। মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স এখনও জনপ্রিয় করা যায়নি বাংলাদেশে। যদিও আইনি সীমাবদ্ধতা উত্তরণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে অনেকদিন ধরে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করলেও খুব বেশি সফল প্রয়োগ হয়নি শস্য বীমার মতো পণ্যসেবা। মাইক্রো বিজনেস কার্ড, মাইক্রো লিজিং, পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনায় নতুন ভাবনা বা প্রয়োগ কোনোটাই করছে না আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশেন নিয়ে বেশ হৈচৈ চলছে। ছোট-বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য থাকতে পারে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। প্রবাসে থাকা বা অনুপস্থিত মালিকের পক্ষে কৃষি জমি আর বাড়িঘর ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজের দায়িত্ব নেয়ার মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও বেশ জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন গবাদি পশুর বীমা করছে এমএফআইগুলো। পণ্য বাজারজাতেও এ ধরনের বীমাসেবা যুক্ত হতে পরে। যে অর্থ ঋণ দেয়া হয়, তা বীমার আওতায় এলে কস্ট অব ফান্ড হয়তো কিছুটা বাড়বে। কিন্তু আখেরে লাভবান হবেন গ্রাহক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক
sirajgonjbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.