৮০তেও আশাবাদী ড. কামাল হোসেন

১৯৯৪ সালে পিএইচডি করতে গেছি লন্ডনে। আমার সুপারভাইজার ফিলিপ স্যান্ডস তখনই আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। আইনজীবী হিসেবেও তিনি আটলান্টিকের দুই পারের দেশগুলোতে বিখ্যাত ছিলেন। মহাব্যস্ত এই মানুষটার সঙ্গে পরিচয়ের দিনটিতেই তিনি ড. কামাল হোসেনের কথা তোলেন। আমি বলি, চিনি তাঁকে, তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছি আমি। ফিলিপ এমনিতেই নিরাশ ছিলেন আমার ব্যাপারে। একজন পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে আমার ভাসা-ভাসা জ্ঞান তাঁকে একদমই খুশি করতে পারেনি। কিন্তু কামাল হোসেনকে চিনি শোনামাত্র তাঁর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো আমাকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। বিদেশে পড়তে গিয়ে, পরে ফেলো হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বা বিভিন্ন কনফারেন্সে গিয়ে বহুবার এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। লন্ডনে ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশন, বনে এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যাসোসিয়েশন, হেগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস—সব জায়গায় অসীম শ্রদ্ধা আর সম্মানের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা।
বিশ্বময় আইন আর মানবাধিকার জগতে বাংলাদেশ মানে একটি নামই শুধু। তিনি ড. কামাল হোসেন। আমাদের কাছে তিনি সুপরিচিত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবে। ১৯৭২ সালে তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত এই সংবিধানটি ছিল সে সময়কালের শ্রেষ্ঠ একটি সংবিধান। এতে ছিল সুশাসন আর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বহু বিধান (যেমন: মূলনীতি, মানবাধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে মন্ত্রীদের জবাবদিহি, শক্তিশালী স্থানীয় শাসন ইত্যাদি)। পরে এই সংবিধানকে প্রত্যেক রাষ্ট্রনায়ক কাটাছেঁড়া করে ক্ষতবিক্ষত করেছেন, সংবিধানের মূল চেতনাকে দলিত করে কালো আইন জারি করেছেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন সংবিধান নির্মাণের সঙ্গেই কেবল যুক্ত ছিলেন, এর বিনাশের সঙ্গে কখনো নয়। শুধু সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে নয়, ড. কামালের পুরোটা জীবন কেটেছে এই ধারাতেই। তাঁর রাজনীতি, আইন পেশা বা সমাজচিন্তা—সবই মানুষের কল্যাণের জন্য, কখনো অশুভ বা অমঙ্গলকর কিছুর জন্য নয়। বরং যা কিছু খারাপ তার বিরুদ্ধে তিনি বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন, মানুষের কাছে আশা-ভরসা আর বিবেকের অনন্য প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গুম, খুন, অন্যায়, শোষণ আর গণতন্ত্র হরণের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধে কেটেছে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়। এই কিংবদন্তিতুল্য মানুষটার ৮০তম জন্মদিন আজ। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের কিংবদন্তিরা কেউ বেঁচে থাকেননি বহু বছর। না বঙ্গবন্ধু, না তাজউদ্দীন, না অন্য কেউ। আমাদের সৌভাগ্য ড. কামাল হোসেন আছেন। কিংবদন্তি হয়ে বহু বছর টিকে থাকা অসাধারণ একটি বিষয়। তিনি সেই অসাধারণ মানুষটি হয়েই রয়েছেন বাংলাদেশের হৃদয়ে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
২. ড. কামাল হোসেনের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনকে আমরা মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগের সূচনায় তিনি একজন পুরোদস্তুর আইনজীবী। অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি আর বিসিএল, লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে বার-অ্যাট-ল করে ফিরে এসে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫৯ সালে। অল্প কয়েক বছরে তিনি একজন তুখোড় আইনজীবী হিসেবে নিজের অবস্থান গড়ে নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় লড়তে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য একজন রাজনৈতিক সহযোগীতেও পরিণত হন। তিনি সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কমিটিকে দেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেন বঙ্গবন্ধু, তার সভাপতি করা হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সী কামাল হোসেনকে। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের (আইন, জ্বালানি ও খনিজ এবং পররাষ্ট্র) দায়িত্ব পালন করেছেন; বহু ভালো ভালো আইন ও নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড তাঁর জীবনের গতিপ্রবাহকে থমকে দেয়। তিনি কোনো দিনই এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। এই হত্যাকাণ্ডের পর তিনি কয়েক বছর আর দেশেই থাকেননি। এ সময় বিদেশে খ্যাতিমান বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, আইনবেত্তা হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন শুরু করেন। এরপর দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনে সম্পৃক্ত হন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে নিবিষ্ট হন, আইন পেশায় আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। ড. কামাল হোসেনের তৃতীয় পর্বের কর্মজীবনের শুরু ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে তিনি রাস্তায় এবং আদালতে সমানভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এরপর গণতন্ত্র, সুশাসন আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু হলে তিনিও রাজনীতিতে তাঁর সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে পড়ে। বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক জ্বালানি, সমুদ্র ও পরিবেশ আইনের একজন অগ্রগণ্য আইনবিশারদ হিসেবে। বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা পারেনি হতোদ্যম করতে। এখনো এই দেশে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যেকোনো উদ্যোগে তিনিই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এই লড়াইয়ে সবচেয়ে নিরবচ্ছিন্ন, একনিষ্ঠ এবং নির্লোভ থেকেছেন তিনি।
৩. ড. কামাল হোসেন একজন রাশভারী চেহারার বিশালদেহী মানুষ। তাঁকে দেখে ঠিক বোঝা যায় না কতটা সংবেদনশীল আর বিশাল হৃদয়ের মানুষ তিনি। অথচ তাঁর সারাটা জীবনই কেটেছে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে আদালতে লড়ে। শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে বস্তিবাসী, বিনা বিচারে আটক অসহায় মানুষ, সুবিধাবঞ্চিত নারী-শিশুসহ বহু মানুষ নির্যাতন, হয়রানি এবং শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে তাঁর নিজের বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। দেশকে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার মামলায় জয়ী করেছেন সিমিটার এবং শেভরনের মতো জায়ান্ট বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলায় লড়ে। দেশের মানুষকে তিনি উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে। বাংলাদেশে যেকোনো সুস্থ ধারার রাজনৈতিক, সামাজিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে তিনি অগ্রগণ্য একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। সংবিধান ছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেছেন। মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মামলায় প্রধান ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, টিআইবি, বিলিয়া, সেইলসসহ বাংলাদেশের খ্যাতিমান সংস্থাগুলো। ড. কামাল হোসেনের ঈর্ষণীয় বহু অর্জন রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তিনি জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ শীর্ষস্থানীয় বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে নেতৃস্থানীয় বা পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের (অক্সফোর্ড, আমস্টারডাম, ডান্ডিসহ) শিক্ষক কিংবা ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন, পৃথিবীর বহু দেশের জন্য খসড়া আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আরবিট্রেশনের চেয়ারম্যান ও গবেষণা জার্নালের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সমুদ্রসীমা নিয়ে রাষ্ট্রসমূহের বিরোধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তাঁর অতুলনীয় মেধা, বাগ্মিতা ও ব্যক্তিত্বের কারণে অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। বাংলাদেশকে নিজের কীর্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবান্বিত করেছেন।
৪.ড. কামাল হোসেন দেশের আর মানুষের প্রতি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরে আর কোনো রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক কি তঁাকে যোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে? ড. কামাল হোসেনকে একবার ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের বিচারক করার উদ্যোগ নিয়েছিল ইউরোপের কয়েকটি দেশ। বাংলাদেশ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি বলে তা হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিলে তাঁর মাপের একজন মানুষকে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবেও হয়তো দেখতে পেতাম আমরা। সেটি কোনো আমলেই করা হয়নি। প্রতিটি আমলেই তিনি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বলেই হয়তো তা হয়নি। এসব নিয়ে কোনো দুঃখবোধ নেই তাঁর। তিনি নিজের প্রসঙ্গে কথাই বলতে চান না। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তাঁর চেম্বারে গেলে তিনি বরং বইয়ের স্তূপ থেকে মুখ তুলে দেশের খবর জানতে চান। একসময় নিজেই বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁর সব কথায় অনিবার্যভাবেই আসে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধু চাইতেন, বঙ্গবন্ধু বলতেন, বঙ্গবন্ধু জানতেন—কোনো দিন এসব ছাড়া কথা বলতে দেখিনি তাঁকে একান্ত আলাপে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কোথায় হারিয়ে গেছে—এটাই তাঁর একমাত্র দুঃখ। কিন্তু তিনি মৌলিকভাবে আশাবাদী মানুষ। কোনো দিন এক টিভি রিপোর্টার বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েছে, কিছু তরুণ রামপালের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, কেউ একজন মানুষের অধিকার নিয়ে লিখেছে—এগুলো বলতে বলতে এখনো আশায় চকচক করে ওঠে তাঁর চোখমুখ। তিনি জানেন না শিশুর মতো সরল এই আশাবাদ কতটা স্বপ্নময় কিংবা অপরাধী করে তোলে আমাদের! ৮০ বছর বয়স হয়েছে তাঁর। অথচ তিনি কামাল হোসেন বলেই এটাও অপ্রতুল মনে হয়। মনে হয় অনন্তকাল যেন বেঁচে থাকেন তিনি এবং তাঁর মতো মানুষেরা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.