যেভাবে ডুবে যায় নৌকাটি

‘তখন প্রচণ্ড বাতাস। সাগরে উত্তাল ঢেউ। যাত্রীবাহী সি-ট্রাকটি তীরে ভিড়তে পারছিল না। তাই মাত্র দেড় শ গজ দূরে তীরে ওঠার জন্য নৌকাই ভরসা। সি-ট্রাক থেকে ঠাসাঠাসি করে ৫৫-৬০ জন যাত্রী তোলা হয় নৌকায়। ইঞ্জিন চালু করে কয়েক গজ সামনে যাওয়ার পরই সি-ট্রাকের সঙ্গে পরপর তিনবার ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায় নৌকাটি।’ এভাবেই নৌকাডুবির ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মোয়াহেদুল মাওলা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার গুপ্তছড়া ঘাটের কাছে ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে ছিলেন তিনি। তিনি সন্দ্বীপের থানা উন্নয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। নৌকাডুবির পর সাগরে ঢেউয়ের সঙ্গে আধা ঘণ্টা যুদ্ধ করেছেন মোয়াহেদুল। জানালেন, ‘যতটুকু মনে পড়ছে, কয়েকবার লোনা পানি খেয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করি। কয়েকজন এসে আমাকে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করছিলেন। চারদিকে তখন বাঁচার আকুতি নিয়ে চিৎকার। একপর্যায়ে উল্টে যাওয়া নৌকাটি দেখে সাঁতরে কাছাকাছি যাই। নৌকাটির ওপরে উঠে সাত-আটজন আশ্রয় নিই। পরে স্পিডবোট এসে আমাদের উদ্ধার করে।’ বেঁচে যাওয়া এই শিক্ষক জানান, সি-ট্রাক থেকে আনুমানিক ২৫-৩০ জন যাত্রী নৌকায় ওঠার পর নতুন করে যাত্রী না নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন যাত্রীরা। এতে রেগে যান নৌকার মাঝি। আরও যাত্রী তোলার জন্য গালাগালি করেন। তখন জোর করে আরও ৩০ জনের মতো নৌকায় তোলা হয়। দুর্ঘটনার পর সি-ট্রাক থেকে কোনো বয়া বা ভাসমান কিছু ফেলা হয়নি।
উল্টে যাওয়া নৌকার ভেতর অনেকে আটকা পড়লেও তাৎক্ষণিক উদ্ধার করা হয়নি। সেটি করা হলে আরও অনেক যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা যেত। এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় আজ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। স্থানীয় সূত্র ও নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনদের থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে উপজেলা প্রশাসন বলছে, নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন। যে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে তাঁরা হলেন বড়দা জলদাশ, সালাউদ্দিন, সচীন্দ্র জলদাশ ও রুহুল আমিন। তাঁদের মধ্যে প্রথম তিনজনের বাড়ি সন্দ্বীপে। রুহুল আমিনের বাড়ি নোয়াখালীতে। তিনি মেয়েকে দেখতে সন্দ্বীপ যাচ্ছিলেন। অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা প্রথম আলোকে বলেন, চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ২৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। আরও ১০ জনের মতো নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের উদ্ধারে কাজ চলছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ফিরে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. গোলাম জাকারিয়া বলেন, এখন পর্যন্ত ১৮ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা জানিয়েছেন। নৌকাটিতে আনুমানিক ৫১ জন যাত্রী থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় ও উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে কাতারপ্রবাসী মুসলিম উদ্দিনের দুজন সন্তান রয়েছে। তারা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পরিবারের সঙ্গে চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে সন্দ্বীপ যাচ্ছিল। তারা হলো তাহসিন (৯) ও নিহা (৪)। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী রয়েছেন।
নিখোঁজদের তালিকা
উপজেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী, নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮ জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা হলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী তানজীম মো. জোবায়েদ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক মো. ওসমান, ইউসুফ আলম ও আনোয়ার হোসেন, আমিন রসুল, মো. শামসু, নিজাম মোস্তফা, কামরুজ্জামান, তাহসিন (৯), নিহা (৪), হাফিজ উল্যাহ, মাঈন উদ্দিন, মো. ইউছুপ, মাসুদ মো. আজিজ, মো. হাসান, সামান্তা, রাবিয়া আক্তার ও নিজাম উদ্দীন। গত রোববার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট থেকে যাত্রীবাহী একটি সি-ট্রাক সন্ধ্যায় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছায়। সি-ট্রাকটি সরাসরি তীরে ভিড়তে না পারায় নৌকায় করে যাত্রীদের তীরে নেওয়া হয়। সি-ট্রাক থেকে তীরে নেওয়ার সময় আনুমানিক ৫১ জন যাত্রীবাহী একটি নৌকা উল্টে যায়। গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত নৌকাটির ২২ জন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। অন্য যাত্রীদের উদ্ধারে অভিযান চলছে।

No comments

Powered by Blogger.