গাজনার বিল বহুমূখী প্রকল্পের কাজ নির্দ্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না

বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের তত্বাবধানে সেনাবাহিনী পরিচালিত রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান লিঃ পাবনার সুজানগরে “গাজনার বিল সংযোগ নদী খনন, সেচ সুবিধা উন্নয়ন ও মৎস্য চাষ” প্রকল্পের আওতায় তালিমনগরে প্রায় ১৭২ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ডুয়েল পদ্ধতির পাম্পিং স্টেশন নির্মান কাজ নির্দ্ধারিত সময় চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হচ্ছে না। এদিকে প্রকল্পের সংশোধিত ডিজাইন ও এষ্টিমেটে পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২৬ কোটি টাকা। বহুমুখী এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিজ পণ্য ও মাছ উৎপাদন হবে। এতে প্রকল্প এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সরকার “গাজনার বিল সংযোগ বাদাই নদী খনন, সেচ সুবিধা উন্নয়ন ও মৎস্য চাষ” প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বহুমূখী প্রকল্প গ্রহন করে। ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে শুরু হওয়া ৩ বছর মেয়াদী এই পকল্পটির কাজ ২০১৩ সালে ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রায় ৩৬ মাস সময় বাড়িয়ে প্রকল্প কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬০ ভাগ। প্রকল্পের ব্যয় ঠিক রেখে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ ২৪ মাস মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবনা পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, বন বিভাগ এবং মৎস্য সম্পদ ও প্রাণী সম্পদ বিভাগকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়।
বেড়া পাউবো বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান লিঃ ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি সুজানগরের তালিমনগরে শুরু হওয়া ডুয়েল পদ্ধতির পাম্পিং স্টেশন নির্মান কাজ ২০১৭ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না। এছাড়া পাম্পিং স্টেশন থেকে কাজিরহাটের যমুনা নদী পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন করা হবে। খালের পানি উত্তোলনের জন্য পাম্পিং স্টেশনে অত্যাধুনিক আটটি পাম্প মেশিন বাসানো কথা রয়েছে। পাম্পিং ষ্টেশনের জন্য ৩৩/১১ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের সংশোধিত এষ্টিমেটে পাম্প স্টেশন নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২৬ কোটি টাকা। জানা যায়, প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর গ্রোস এরিয়ার এই প্রকল্পে ১৭ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে। এই প্রকল্পে মোট ৫০ কিলোমিটার বাদাই নদী খনন, ১১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সেকেন্ডারি খাল, ৪৯ কিলোমিটার প্রধান সেচ খাল, তালিমনগরে একটি পাম্পিং স্টেশনসহ নানা প্রকার ভৌত অবকাঠামো নির্মান করা হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এক ফসলী জমি দুই ফসলী এবং দুই ফসলী জমি তিন ফসলীতে রুপান্তরিত হবে। ফসলের উৎপাদন ১৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০০ শতাংশতে উন্নিত হবে। এতে করে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিজ পণ্য উৎপাদন হবে। গাজনার বিল, বিল গ্যারগা, গাঙভাঙ্গার বিল ও মোস্তার বিলের অভয়াশ্রম থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যাবে। সাবমার্জএবল সড়ক পথে শুস্ক এবং বর্ষা মওসুমে কৃষকেরা সরাসরি মাঠ থেকে ফসল ঘরে নিতে পারবেন। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় বৃক্ষ রোপণ করা হবে।
এদিকে “গাজনার বিল সংযোগ নদী খনন, সেচ সুবিধা উন্নয়ন ও মৎস্য চাষ” প্রকল্পের ভৌগলিক অবস্থান গত কারণ বিবেচনা করে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের ষ্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়। সেটি এখন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্প ব্যয় না বাড়িয়ে আগের ডিপিপি থেকে কিছু কিছু ভৌত অবকাঠামো বাদ দিয়ে নতুন ভাবে ১৭টি হেড রেগুলেটর/চেকষ্ট্রাকচার ও ২টি ব্রীজ সংযোজন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় ৫০ কিলোমিটার আত্রাই ও বাদাই নদী খনন করা হয়েছে। প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি গ্রুপে জিয়ার জোলা, আত্রাই নদী, হিরন নদী, নাগনাখালী ও ভাদুরঠাকুরের জেলার ৬৮ কিলোমিটার খনন করে শাখা খাল তৈরি করা হচ্ছে। গাজনার বিল, বিল গ্যারগা, গাঙভাঙ্গার বিল ও মোস্তার বিলের অভয়াশ্রমে দেশী প্রজাতি বিভিন্ন মাছ চাষ করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় ৪৯ কিলোমিটার প্রধান সেচ খাল, প্রায় ৪৫ কিলোমিটার শাখা খালসহ নানা ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মান কাজে হাত দেয়া হয়নি। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও মৎস্য সম্পদ বিভাগ প্রকল্প এলাকায় কিছু কিছু কাজ করেছে। তবে বন বিভাগ ও প্রাণী সম্পদ বিভাগ কোন কাজ না করেই প্রকল্প গুটিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই দুটি খাতে বরাদ্দ অর্থ কি করা হয়েছে তা জানা যায়নি। তালিমনগরে বেড়া পওর বিভাগের অধিন সুজানগর উপবিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী এ.এম রশিদ জানান, পাম্পিং ষ্টেশনের নির্দ্ধারিত জায়গায় গোরস্থান ও মাসজিদ ছিল। এগুলো স্থানান্তর নিয়ে এলাবাসীর সাথে সৃষ্ট জটিলতার কারণে নির্মাণ কাজ প্রায় দেড় বছর পিছিয়ে যায়। এ কারণে নির্দ্ধারিত সময় ২০১৭ সালের ৩০ জুনে নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ জন্য ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্মাণ কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে। বর্তমানে পাম্পিং ষ্টেশন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৫৫ ভাগ। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ৮৮ ভাগ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। পাম্পিং ষ্টেশন নির্মাণের জন্য ৮৯ মিটার লম্বা ৬৮ মিটার চওড়া ও ১২ মিটার গভীর একটি পুকুর খনন করা হয়েছে। সেখানে পাইলিং ও আরসিসি ফাউন্ডেশনের (ভিত্তি) কাজ শেষ হয়েছে। রড বাঁধাই (বাইন্ডিং) ছাড়া মূল অবকাঠামো, সিসি ব্লক নির্মাণ, মেশিনের সাহায্যে মাটিকাটা, ডিওয়াটারিংসহ অন্যান্য কাজ চলছে। ফাইন্ডেশনের উপর নির্মিত অবকাঠামোতে অত্যাধুনিক ৮টি পাম্প মেশিন স্থাপন করা হবে। আটটি পাম্প মেশিনের পানি উত্তোলন ও নিস্কাশন ক্ষমতা এক হাজার ৪০০ কিউসেক। গাজনার বিল বহুমূখী প্রকল্পের আড়াইডাঙ্গি, বিলবাউসি, চৈত্রহাটি, বিলগাজনা, পুরাডাঙ্গা, মধুপুর এলাকায় দেখা যায়, বাদাই ও আত্রাই নদী খনন করায় বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা দুর হয়েছে। দিগন্ত বির্¯Íৃীর্ণ হাজার হাজার হেক্টর জমিতে কৃষকেরা রকমারি ফসল ফলাচ্ছেন। নদী বিলে মাছের চাষ হচ্ছে। বাদাই কদমতলি গ্রামের কৃষক শ্রী বিমল চন্দ্র বিশ্বস, পুরাডাঙ্গার জরু মোল্লা, বিলবাউসার তাহের মোল্লা, চৈত্রহাটির আব্দুল্লাহ্, শ্রীকোল গ্রামের আউব আলী জানান, শুকনো মওসুমে বাদাই নদী শুকিয়ে যেতো। পানির জন্য তাদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বাদাই ও আত্রাই নদী খনন করায় জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানির অভাব দুর হয়েছে। ফলে দিগন্ত বিস্তীর্ণ বিলাঞ্চলে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে এখন পেঁয়াজ, ডাল, পাটল, মরিচ, পাট, বোরো, আমন ধানসহ নানা ফষল আবাদ হচ্ছে। স্থাপিত হয়েছে নৌ-যোগাযোগ।
এলাকার কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বলে তারা জানিয়েছেন। বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের সুজানগর পওর উপ-বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, পাম্পিং ষ্টেশন নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ৮৮ ভাগ এবং ২০১৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পাম্পিং ষ্টেশন নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ হবে। প্রকল্প এলাকায় নানা ধরনের জটিলতার কারণে নির্দ্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকল্প কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। সেটি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এতে অতিরিক্ত কোন অর্থ ব্যয় হবে না। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর গঠিত টাস্কফোর্সের তত্বাবধানে ডিজাইন অনুয়ায়ী কাজ বুঝে নেয়া হচ্ছে। এর ফলে “গাজনার বিল সংযোগ নদী খনন, সেচ সুবিধা উন্নয়ন ও মৎস্য চাষ” প্রকল্পে নদী খননসহ অন্যান্য কাজে ফাঁকী দেয়ার কোন সুযোগ নেই বলে জানান। বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। কৃষির সাফল্য জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। এই প্রকল্পের ২৭ হাজার হেক্টর জমি নিস্কশন এবং ১৭ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে। এক ফসলী জমি দুই ফসলী এবং দুই ফসলী জমি তিন ফসলীতে রুপান্তরিত হবে। প্রকল্প এলাকায় বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিজ পণ্য ও দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদন হবে। এতে এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপরে উঠে আসবে। আর্সেনিক প্রবনতা কমে যাবে। এলাকার আবহাওয়া থাকবে শীতল।

No comments

Powered by Blogger.