চেয়ারে বসতে না বসতেই বরখাস্ত

বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর দায়িত্ব শুরু করেছিলেন তারা। মাঝে মামলায় জড়িয়ে বহিষ্কার হন দায়িত্ব থেকে। এরপর দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে আবার বসেছিলেন চেয়ারে। কিন্তু তাদের এ বসার ক্ষণ একজনের দশ মিনিট, এক জনের আড়াই ঘণ্টা আর একজনের ১১ দিন। ভাগ্যবিড়ম্বিত এ তিন জনপ্রতিনিধি হলেন  সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জিকে গউছ। দুই মেয়র আদালতের নির্দেশে গতকালই দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলেন। আর ১১ দিন আগে দায়িত্ব নিয়েছিলেন গউছ। দুপুরে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই ঘণ্টার মাথায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আবার বরখাস্ত হন আরিফুল হক চৌধুরী। দায়িত্ব নিতে সকালে নগর ভবনে যাওয়া বুলবুল নানা নাটকীয়তায় নিজের কক্ষ বুঝে পান দুপুরে। এর ১০ মিনিটের মাথায় ফের বরখাস্তের নির্দেশ পৌঁছে নগর ভবনে। একই দিন হবিগঞ্জের মেয়র জিকে গউছের বরখাস্তের আদেশও যায় পৌর ভবনে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এভাবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বারবার বরখাস্তের ঘটনায় তিন নির্বাচনী এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় সরকারে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের প্রচলন  করার পর রাজনৈতিক মামলায় এভাবে জনপ্রতিনিধিরা বরখাস্ত হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কখনও স্থিতিশীল হবে না।
সকাল বেলার মেয়র বিকেলেই পদহারা
মায়ের দোয়া নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। যাবার আগে দু’হাত তোলে খোদার কাছে মোনাজাতও করেছিলেন। যেন আর কোনো বাধা তাকে নগরবাসীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে না দেয়। নগরবাসীকে দেয়া যেসব প্রতিশ্রুতি দায়িত্ব থেকে দূরে থাকার কারণে এতদিন পূর্ণ হয়নি ইচ্ছে ছিল  নতুন করে দায়িত্ব পেয়ে সে কাজগুলো আবার হাতে নেবেন। রাতভর টানা বৃষ্টির শব্দ শুনে ভেবে নিয়েছিলেন সবার আগে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার মিশনটি আবার পুরোদমে শুরু করবেন। সবকিছু তছনছ হয়ে যায় স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মো. মাহমুদুল আলম স্বাক্ষরিত এক পত্রে। সোয়া দুই বছর পর মাত্রই ঘণ্টা তিনেকের জন্য মেয়রের চেয়ারে বসার পর আবারও বরখাস্ত হন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে আরিফুল হকের।
আরিফুল হক চৌধুরী কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। কেন বারেবারে এমন হচ্ছে। নগরবাসী ভালোবেসে তাকে যে দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন তা পালনে কেন বঞ্চিত হচ্ছেন বারবার। অনেক স্বপ্ন ছিল তার এ নগরকে ঘিরে কিন্তু কিছুই তো করার সুযোগ পাচ্ছেন না। একটি আধুনিক-দৃষ্টিনন্দন নগরের যে স্বপ্ন তার চোখে বারবার উঁকি দেয় তাকে কাজে পরিণত করতে না পারার বেদনা তাকে বারেবারই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
বরখাস্তের আদেশ মাথায় থাকায় সোয়া দুই বছর ধরে তিনি নগরভবনের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। সে আদেশ মাথার উপর থেকে সরে পড়ায় রোববার আবার নগরভবনের পথ ধরেছিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সকাল ১০টায় শুভার্থী ও স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে নিয়ে পায়ে হেঁটে ঘর থেকে বের হন। রাস্তার দু-পাশের মানুষ তাকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান, অনেকদিন পর পাওয়া সুখের এ মুহূর্তটিকে দীর্ঘায়িত করতে কুমারপাড়ার বাসা থেকে নগরভবন পর্যন্ত পুরো পথটিই পায়ে হেঁটে পাড়ি দেন আরিফুল হক। ১১টার দিকে পৌঁছেন নগর ভবনে। সেখানে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরিফকে ফুলেল অভ্যর্থনা জানান। পরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবিব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন আরিফুল হককে। দুপুর ২টার দিকে হঠাৎই খবর ছড়িয়ে পড়ে আরিফুল হককে আবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এক কান দু-কান হয়ে আরিফুল হকের কানেও যায় বার্তাটি। হৃদয়ভাঙার কষ্ট নিয়ে দুপুর ৩টার দিকে বাসায় ফিরে আসেন। বাসায গিয়ে সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হন। এ সংক্রান্ত কোনো কাগজ হাতে না পেলেও আরিফুল হক তারপর আর ফিরে আসেননি নগরভবনে।
সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। জনতার বিপুল রায়ে ২০১৩ সালের ১৫ই জুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। ৪৬ মাসের মধ্যে মাত্র ৯ মাস চেয়ারে বসতে পেরেছেন তিনি। নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু সময় না পাওয়ায় সব কাজই অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। ফুটপাথ দখলমুক্ত করে নগরের যানজট নিরসন করা ও জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টিকে প্রথম চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন আরিফুল হক। স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় নাম উঠে এলে কারাবন্দি হন, পদও হারান। ছন্দপতন ঘটে আরিফুল হকের হাতে নেয়া কাজগুলোর ক্ষেত্রে। ২৭ মাস পর আইনি বাধা পেরিয়ে আবার ফিরে পেয়েছিলেন নগরীর দায়িত্ব। অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পূর্ণ করে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের তাগিদ ছিল ভেতরে। তাই দায়িত্ব পেয়ে সেগুলোর প্রতি নজর দিতে চেয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। তবে ঘণ্টা তিনেক দায়িত্ব পালন না করতেই তার মাথার আবার নেমে আসে শাস্তির খড়্‌গ।
কিবরিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে চার্জশিটভুক্ত হওয়ার পর অত্মসমর্পণ করলে ২০১৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর হবিগঞ্জের একটি আদালত আরিফুল হককে কারাগারে পাঠায়। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে চলতি বছরের ৪ঠা  জানুয়ারি আরিফুল কারাগার থেকে মুক্তি পান। এদিকে, কারাবন্দি থাকাবস্থায় ২০১৫ সালের ৭ই জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সিলেটের মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে। বরখাস্তের ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন আরিফুল হক। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৩ই মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশটি ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে দেন। এই আদেশ স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ২১শে মার্চ চেম্বার বিচারপতির আদালতে আবেদন করেন। সেদিন চেম্বার বিচারপতি বিষয়টি নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেন। ২৩শে মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার ‘নো অর্ডার’ দিলে আরিফুল হকের দায়িত্ব ফিরে পাওয়া সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক পত্রে তাকে মেয়রের দায়িত্ব নিতে বলা হয়। দায়িত্ব নেয়ার তিন ঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার বরখাস্তের আদেশ আসে। এবার আদেশ আসে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত মামলায়। কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাগারে থাকতেই এ মামলার চার্জশিটে নাম উঠেছিল আরিফুল হকের। গত ২২শে মার্চ সে চার্জশিট আদালতে গৃহীতও হয়। সে সূত্রেই আবারও সাময়িকভাবে বরখাস্ত হলেন আরিফুল হক চৌধুরী। আরিফুল হক চৌধুরী বললেন, জেনেশুনে কোনো অপরাধ করিনি কখনও। জানি না কেন বারেবারে এভাবে ফেঁসে যাচ্ছি। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আবার নিজের অধিকার ফিরে পাবেন এমনটি বিশ্বাস করেন জানিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী বললেন, জনতার রায় কোনোভাবেই বিফলে যেতে দেব না। জনতার ভরসার সম্মান রাখতে নিজের শেষ রক্তবিন্দু  দিয়ে হলেও চেষ্টা করে যাব।
বিএনপির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ও হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ জিকে গউছকে মেয়র পদে দায়িত্ব নেয়ার ১১ দিনের মাথায় ফের বরখাস্ত করা হয়েছে। রোববার বিকালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তার বরখাস্তের আদেশের কপি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে পৌঁছে। সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের আদেশের কপি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন হবিগঞ্জ স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক উপ-সচিব মো. সফিউল আলম। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের একটি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মেয়র জিকে গউছ বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে এসে দায়িত্ব নিয়েছি। আবারো আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আদালতে যাব। অন্যায়, অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে আদালতে সু-বিচার প্রত্যাশা করেন তিনি। উল্লেখ্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় ২০১৪ সালে দেয়া সর্বশেষ সম্পূরক অভিযোগপত্রে মেয়র জি কে গউছকে আসামিভুক্ত করা হয়। একই বছর ২৮শে ডিসেম্বর তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সম্প্রতি তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। এরপর ২৩শে মার্চ মেয়র হিসেবে হবিগঞ্জ পৌরসভার দায়িত্ব নেন।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ ২৩ মাস পর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র হিসাবে চেয়ারে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যে ফের বরখাস্ত হন মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। গতকাল সকাল ১০টার দিকে পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী নগর ভবনে যান মেয়র বুলবুল। এ সময় তার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ছিলেন। তবে মেয়রের কক্ষে তালা দেয়া থাকায় তিনি বেলা ১১টায় ডাকা সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে বসেন। এরপর প্রায় ৫ ঘণ্টার প্রতীক্ষা আর নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিকাল সোয়া ৩টায় মেয়রের নির্ধারিত চেয়ারে বসেই সাংবাদিকদের উদ্দেশে ব্রিফিং করেন বুলবুল। এ সময়ই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ফ্যাক্সে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মেয়রকে সাময়িক বহিষ্কারাদেশ এসে পৌঁছায়।
মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, রাজশাহীর ১২/১৩ লাখ মানুষ আমাকে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ পাকের রহমতে আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করি। কিন্তু ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বা সামাজিক যে কারণেই হোক মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত রাসিকে তিনজন নির্বাচিত মেয়র দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু তার দায়িত্ব পালন করেছেন, সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান দায়িত্ব পালন করেছেন। আর আমাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ওই সাসপেন্ডাদেশ বাতিল ঘোষণা করেছেন। আগামী নির্বাচন (রাসিক) না হওয়া পর্যন্ত কিংবা পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত (উচ্চ আদলতের) আমিই মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবো। রাজনৈতিক কারণে হাজারো মামলা করা হলেও আমিই মেয়র থাকবো। আমি আজ থেকে প্রতিদিন নগরভবনে আসবো। মেয়র হিসেবে জনগণের সেবা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। এ সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রালয়ের ফ্যাক্সের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি ফ্যাক্সের বিষয়টি জানি না। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর এই ধরনের ফ্যাক্সের কোনো আইনগত ভিত্তি থাকে না।

No comments

Powered by Blogger.