স্বৈরাচারবিরোধী গণ–অভ্যুত্থানের ২৫ বছর by মিজানুর রহমান খান

আজ ১ ডিসেম্বর। আর কদিন পরই জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সফল হওয়ার ২৫তম বার্ষিকী। একটানা সাড়ে আট বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম গণতান্ত্রিক লড়াই। এতে কত মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, কত মানুষ আহত বা তাঁদের কতজনের স্থায়ী অঙ্গহানি ঘটেছিল, সরকারি ও বেসরকারি খাতে কী পরিমাণ সম্পদের হানি ঘটেছিল, তার সঠিক হিসাব আজও করা হয়নি। এমনকি তেমন জোরালো দাবি কখনো ওঠেনি।
১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর সারা দেশ ছিল উত্তেজনায় উত্তপ্ত। মিরপুরে হরতাল চলাকালে জনতার মিছিলে তৎকালীন বিডিআর গুিল চালিয়েছিল। এতে ঘটনাস্থলেই পাঁচজন নিহত হন। এদিন অবশ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও ছয়টি পৃথক সহিংস ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। আহত হয়েছিলেন অনেকেই। এর পাশাপাশি সরকারের গ্রেপ্তার অভিযান চলছিল। রাজনীতিবিদেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সাংবাদিকদের আন্দোলনের কারণে ২৮ নভেম্বর থেকে কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। রাষ্ট্রীয় বেতার– টিভিতে আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো খবর ছিল না। ফলে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সংবাদই ছিল ভরসা।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন প্রথমবারের মতো সব মত ও পথের মানুষ, বিশেষ করে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক কর্মী এবং পেশাজীবীদের কাছাকাছি এনেছিল। তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন রাজনৈতিক ঐক্য। তিন জোটের রূপরেখায় সমগ্র জাতির ন্যূনতম দাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। বিভিন্ন ধরনের এমনকি মতাদর্শগতভাবে পরস্পরবিরোধী সংগঠন ও নেতারা একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন। ২৫ বছর পরে সেদিনের ওই অর্জনকে আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়।
১৫, ৭ ও ৫-দলীয় জোটের আওতায় মধ্য, বাম, ডান শক্তির সম্মিলন ঘটেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটা এর আগে কখনো ঘটেনি।
গত আড়াই দশকের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে রাজনৈতিক বিভাজন ও বিভক্তি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার দশক পূর্তি না হতেই আমাদের জাতীয় নেতারা আবারও শোক কাটিয়ে উঠতে না পারা জনগোষ্ঠীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন, ‘আসুন, গণতন্ত্রের লড়াইয়ে যোগ দিন। আসুন, সামরিক শাসন উচ্ছেদ করি।’
নব্বইয়ের ডিসেম্বরে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল। সাধারণভাবে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ কথাটির ব্যবহার ব্যাপক কিন্তু গবেষক ও রাজনীতিবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বেশ সন্দিহান। তাঁরা যুক্তি দেখান যে গণ-অভ্যুত্থান ঘটলে কী করে কতিপয় মৌলিক গণ-আকাঙ্ক্ষা আজও অপূরণীয় থাকতে পারল।
উল্লেখ্য, তিন জোটের রূপরেখায় এমন কতগুলো বিষয় ছিল একান্তভাবে শাসনগত। কোনো দলের মতাদর্শগত বিষয় ছিল না। ১৯৯০-এর ১ ডিসেম্বরে জন্ম নেওয়া শিশুটির আজ ২৫তম জন্মদিন। তাদের নতুন করে জানা উচিত তাদের পূর্বপুরুষেরা অবাধ নির্বাচন, বাক্ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার খর্বকারী কালাকানুন বাতিলের মতো কয়েকটি দাবি প্রতিষ্ঠায় থেমে থেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের জীবনে ১৯৬৯ ও ১৯৯০–এ একটি অভিন্ন স্বপ্ন বুকে ধরেছেন।
সাতাশিতে একজন নূর হোসেন বুকে-পিঠে উল্কি দিয়ে সেই স্বপ্ন এঁকেছিলেন: স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। তিন জোটের রূপরেখায় লেখা হয়েছিল: ‘সাংবিধানিক পন্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে। সংসদকে সার্বভৌম করতে হবে। গণপ্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখতে রেডিও-টিভিসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। মৌলিক অধিকার পরিপন্থী সব আইন বাতিল করতে হবে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ২৫ বছর পরে আজ অনেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জীবনমানের উন্নতি অর্থাৎ মানুষের রুজি–রোজগার বৃদ্ধির মতো কিছু বিরাট প্রাপ্তির জন্য সন্তোষ আর তিন জোটের রূপরেখায় দেওয়া শাসনগত প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার বঞ্চনায় বেদনাহত হতে পারেন। যদিও তাঁরা সাহসের সঙ্গে দৃঢ়চিত্তে বলবেন, ‘গণতন্ত্রের ঘাটতি’ পূরণের লড়াই চলছে এবং চলবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.