মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নির্মূল হবে জঙ্গিবাদ

ডিসেম্বর মাস এলেই আমাদের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের কথা মনে পড়ে। একাত্তরের ডিসেম্বরে আমরা একটা ভয়ংকর আতংকের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু এই ডিসেম্বরেই আতংকগুলো কেটে যাচ্ছিল, কারণ সবাই এটা বুঝতে পারছিল পাকিস্তানিরা পারবে না, তাদের পরাজয় হবে। কিন্তু পরাজয়ের মুখে হানাদার পাকসেনারা ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ভয়ানক যে ঘটনাটি ঘটায় সেই শোকাবহ ঘটনাটি আমাদের বিজয়ের আনন্দকে বিষাদে পূর্ণ করে তোলে। তাই আমাদের বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে বিষাদও জড়িয়ে গিয়েছিল। যারা শহীদ হলেন তারা আমাদেরই সহকর্মী-বন্ধু-ভাই ও আত্মীয়স্বজন। তাই আমাদের বিজয়ের আনন্দ অবিমিশ্র ছিল না। এত বড় ক্ষতি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে একটা আশা ছিল, আমরা এ ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। স্বপ্ন ছিল আমরা যে নতুন দেশটি পেলাম সেটি আমরা গড়ে তুলতে পারব। ১৬ ডিসেম্বর আমরা যেন একটা রোগ থেকে মুক্তি পেলাম।
আমরা যে স্বপ্ন দেখতাম সেই স্বপ্ন আবার দেখতে শুরু করলাম। আমরা একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতাম, যে বাংলাদেশ একটা নতুন ধরনের রাষ্ট্র হবে, তার সমাজ হবে বৈষম্যহীন। যে দেশে সব মানুষের অধিকার এবং সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু গত ৪৪ বছরে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত তো হয়ইনি বরং যা ছিল অকল্পনীয় তাই ঘটেছে জঙ্গিদের উত্থানের মধ্য দিয়ে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি আলবদর বাহিনীর বর্বরতার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। একাত্তরে তাদের পৃষ্ঠপোষক হানাদার পাকসেনাদের পরাজয়ের মাধ্যমে ভাবা গিয়েছিল এদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে কিন্তু তা ঘটেনি। ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হয়নি, বিচার করা হয়নি তাদের সহযোগীদেরও। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এরা আবার বেড়ে উঠেছে। পুনর্বাসিত হয়েছে সমাজে। আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম সে সময়, আলবদর একটি রোগের নাম- সুযোগ পেয়ে, পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আবার বেড়ে উঠেছে সেই রোগ। এই রোগ ফিরে আসার কারণ হচ্ছে এ রোগের লালনক্ষেত্র রয়েই গেছে। এ দেশে সব মানুষের অধিকার এবং সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি, সমাজটিকে মানুষের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়নি। এখানে মানুষের অধিকারগুলো স্বীকৃতি পায়নি। এখানে মানুষের নিরাপত্তা বাড়েনি। সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, দেশে এখন মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বিশ ভাগ;
তার অর্থ হচ্ছে শতকরা আশি ভাগ মানুষ হচ্ছে দরিদ্র। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে বঞ্চনা বোধ ও বিক্ষোভ আছে। বিনিয়োগের অভাবে বেকারত্ব আছে সর্বোপরি আছে নিরাপত্তাহীনতা। এসব মিলে বর্বরতার পুরনো রোগটিকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। শিক্ষাকে সার্বজনীন করা যায়নি। চালু করা যায়নি অভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি। মাতৃভাষার মাধ্যমে সবার জন্য একই শিক্ষার ব্যবস্থা না করায় সমাজে বৈষম্যের সূচনা ঘটছে শুরু থেকেই। উচ্চবিত্তদের সন্তানদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে বিদেশী কারিকুলাম অনুযায়ী, মধ্যবিত্তদের জন্য একরকম আর দরিদ্রদের সন্তানদের জন্য মাদ্রাসা। দেশে এত মাদ্রাসা পাকিস্তান আমলেও ছিল না। গরিব মানুষের সন্তানরা মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে কর্মহীন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। খুব সহজেই এদেরকে বিভ্রান্তি পথে পরিচালিত করা সম্ভব হচ্ছে। এদের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররাও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আলবদর এই রোগের মূল উৎপাটনের জন্য তাই বাংলাদেশের জন্মলগ্নের স্বপ্ন সব মানুষের অধিকার এবং সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। ডিসেম্বর মাস আমাদের সে কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

No comments

Powered by Blogger.