দৃশ্যমান হচ্ছে ষড়যন্ত্র by মাসুদ করিম ও সৈয়দ আতিক

দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে এ মুহূর্তে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে দেশী-বিদেশী চক্র। এরই অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে বিদেশী হত্যা, পুলিশ হত্যা, শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, খ্রিস্টান যাজকদের ওপর হামলা ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিচ্ছিন্নভাবে এসব চোরাগোপ্তা হামলার পরপরই হামলার জন্য আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করেছে বলে ঘোষণা দিচ্ছে সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ নামের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ওয়েবসাইট। আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই- সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও বাংলাদেশে আইএস সক্রিয় বলে প্রচার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ওই মহলটি। কোনো সন্ত্রাসী ঘটনার পর আইএসের দায়ের কথা উল্লেখ করে সন্ত্রাস দমনে সহায়তা দিতে ইচ্ছুক- এ মর্মে বিবৃতিও দিচ্ছে তারা। বিশ্লেষকদের মতে, আইএসের উপস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানিয়ে অকার্যকর করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখন সহায়তা দেয়ার নামে বাংলাদেশে ঢুকতে চায় তারা। তাদের এমন তৎপরতার ইঙ্গিত দিয়ে দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশংকার কথা বলেছিলেন সেটিই এখন ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেদারল্যান্ডস সফর শেষে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে অনিরাপদ প্রমাণ করে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ার মতো দেশে পরিণত করতে দেশের ভেতরে ও বাইরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ ও বিদেশী হত্যা, তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘এসব ঘটনা পরিকল্পিত। বাংলাদেশের ওপর হামলে পড়তে এমন আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশে আইএস আছে বলে স্বীকারোক্তি আদায়ে চাপ আছে। বাংলাদেশ অনিরাপদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস যেটা বলা হচ্ছে, যা করা হচ্ছে এটা আর্টিফিসিয়াললি করা হচ্ছে।’
বিশ্লেষকদের মতে, আইএস সৃষ্টির পেছনে পশ্চিমা বিশ্বশক্তির হাত থাকতে পারে। পশ্চিমারা ‘হাকিম হয়ে হুকুম করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে’। পশ্চিমাদের এই দ্বিমুখী চরিত্র বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলেছে কয়েক দশক ধরে। আইএস সৃষ্টি করে তারা মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করেছে। এখন তারা এশিয়াতেও ঢুকতে চায়। ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়ে তাদের স্বার্থ রয়েছে।
এদিকে বর্তমান সরকার অতিমাত্রায় পূর্বমুখী এবং প্রতিবেশী ঘেঁষা। পশ্চিমাদের সঙ্গে নানা ইস্যুতে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। চীনের অর্থনীতি ও সামরিক উত্থানও পশ্চিমারা তেমন ভালো চোখে দেখছে না। চীনবিরোধী দেশগুলো (যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ) এ অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকতে চাচ্ছে। আর ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশে অবস্থান বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে খুই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংযোগস্থলের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায় তারা- মন্তব্য বিশ্লেষকদের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করতে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করছে। এরাই দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে দেশের নামে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। তাদের ষড়যন্ত্রে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিবৃতি পাঠানো হচ্ছে। তিনি জানান, যারা বলছে বাংলাদেশ নিরাপদ নয়, খাদের কিনারে গণতন্ত্র তারাই এ ধরনের তৎপরতা চালিয়ে দেশকে অকার্যকর করতে মরিয়া হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রই মূলত এ দেশে আইএস আছে বলে প্রচার করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, বিদেশীরা যে যার মতো অবাধে চলাফেরা করছে, কোথাও কোনো ধরনের সমস্যা নেই। গত বছরের নভেম্বর মাসের তুলনায় চলতি নভেম্বরে ১০ হাজারের বেশি বিদেশী বাংলাদেশে এসেছেন। যদি এ দেশ অনিরাপদই হতো তাহলে এত বেশি বিদেশীর আগমন ঘটত না। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশ যে সতর্কবার্তা জারি করে, এগুলোও ষড়যন্ত্রেরই অংশ। কথিত বিবৃতি দিয়ে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে এগুলো কারা করছে, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। সময় হলে সবকিছুই জাতির কাছে তুলে ধরা হবে। তিনি  বলেন, আগেও বলেছি, এখনও বলছি এ দেশে আইএস নেই। তবে জামায়াত নামে যে সংগঠনটি নিষিদ্ধ সংগঠনের তালিকায় আসছে সেই সংগঠনসহ সরকারবিরোধীরা এসব কিছু তৈরি করে দেশের ভেতরে একটা অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়েই বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হবে। কারণ যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চায় না। এই গোষ্ঠী যতই বিবৃতি দিক না কেন, এসব আমরা পাত্তা দিচ্ছি না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশী-বিদেশী চক্র দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে এমন নাশকতার আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে। দু’জন যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেতে থাকে। বিদেশীদের ওপর জঙ্গি হামলা হতে পারে বলে যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে গোয়েন্দা তথ্য দেয়া হয়। তারপর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়ে যায়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন তার বাসভবনে বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে বলেন, তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের তথ্য আছে যে, বাংলাদেশে পশ্চিমা স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থানে হামলা হতে পারে। ঘটলও তাই। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের আশংকা প্রকাশের দু’ঘণ্টার মধ্যে গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লাকে গুলি করে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। তারপর নিরাপত্তার অজুহাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হুগো শোয়ারের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়ে যায়। বিদেশী কনসার্টসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাতিল হয়।
বাংলাদেশে আইএস নেই বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও একই কথা বলেছেন। তবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ নাগরিক বাংলাদেশে এসে আইএসের জন্য কর্মী সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যুগান্তরকে বলেছেন, ওই ব্যক্তিকে ধরে যুক্তরাজ্যের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া আইএসের কোনো কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে দেখা যায়নি বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। তাভেল্লার পর ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। পবিত্র আশুরার আগে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির লগ্নে পুরান ঢাকায় হোসনি দালানে গ্রেনেড হামলা চালানো হল। এভাবে একের পর এক ছক করে পুলিশ চেকপোস্টে, দিনাজপুরে ধর্মীয় যাজক, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে নাশকতা চালানো হচ্ছে। সবকিছুই একই সূত্রে গাঁথা বলে মন্তব্য বিশ্লেষকদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ আবহমান কাল থেকেই শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। এ দেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসীসহ বিভিন্ন জাতের মানুষের বসবাস। সে ধরনের কোনো সংঘাত নেই। শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে পরিচিত। কিন্তু ইদানীং বিশ্ব পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বোম্বিং হচ্ছে আইএস, আল কায়দা এসব করছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়দা আছে বলে মনে হয় না। কারণ আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ জাতি। আমাদের ভেতরে কোনো বিভেদ নেই। সবার মাঝে একটা মধুর সম্পর্ক।
সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের কিছু ছিটেফোঁটা এসে লাগছে এখন এ দেশে। বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস আছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। যাদের মাধ্যমে আইএসের উত্থান হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারাই এ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। একসময় বাংলাদেশে জেএমবির জঙ্গিরা ছিল। কিন্তু তাদের সর্বোচ্চ আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা প্রতিহত করেছি। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের যে সংকট আছে, তা যদি আমরা জাতীয়ভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি তাহলে কোনো গোষ্ঠীই আমাদের বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা কোনো ব্যাপারই নয়।
সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে অহেতুক কয়েকটি দেশের আতংক সৃষ্টির পদক্ষেপ চোখে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কতিপয় দেশ বাংলাদেশে ভ্রমণে সতর্কতা অবলম্বনের বার্তা দিচ্ছে। যদিও অধিকাংশ দেশই এমন কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি। বিশেষ করে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন তার সর্বশেষ বিবৃতিতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে বিদেশী সহায়তার প্রস্তাব রেখেছেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে হোসনি দালানে বোমা হামলার পর বগুড়ার শিয়া মসজিদে হামলা চালানো হল। পুলিশকে খেপিয়ে তুলতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জাতিসংঘ, পাকিস্তানসহ কোনো কোনো মহল নেতিবাচক মন্তব্য করছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ইস্যু উত্থাপিত হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সজেন্ডার নিকোলায়েভ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে যে ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেটি কোনো মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করছে। সম্প্রতি বগুড়ার শিয়া মসজিদে গুলিবর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বগুড়ায় ৩০ বছর ধরে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকরা বসবাস করছে। কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশে কখনোই গোত্রগত সংঘাত ছিল না। ফলে এই সংঘাতময় পরিস্থিতি যে পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা সহজেই  অনুমেয়। এখন সবাইকে ভেবে দেখতে হবে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কাদের স্বার্থ হাসিল করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আর কোনো মন্তব্য না করে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, একজন বিদেশী হিসেবে এর চেয়ে বেশি তিনি বলতে পারেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান যুগান্তরকে বলেন,  বগুড়ায় শিয়া মসজিদের মুয়াজ্জিন হত্যার সঙ্গে তাজিয়া মিছিলে হামলার একটা যোগসূত্র আছে। বাংলাদেশে একপ্রকার জঙ্গিগোষ্ঠী আছে যারা বিদেশীদের মদদপুষ্ট হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এমন ঘটনা বারবার ঘটাচ্ছে। তারা প্রমাণ করতে চাইছে, বাংলাদেশে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। যেমনটা রয়েছে পাকিস্তানে। কিন্তু গত ৪০০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে এমন কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। এখনও নেই, বরং শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে সুন্নিরাই বেশি অংশ নিয়ে থাকে। একটা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার লক্ষ্যে বারবার এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমি মনে করি, সবাই মিলে এসব অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করা উচিত।
যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করা বা রায়ের পর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যে ধরনের বিবৃতি প্রদান করছে তারা করতে পারে না। কারণ যে কোনো স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা জাতিসংঘের চার্টারে বর্ণিত নীতিমালার ২নং ও ৭নং ধারার বরখেলাপ। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে জাতিসংঘ নিজেই তার নিজের বিধি লংঘন করেছে। কেননা তারা সেটা করার অধিকার রাখে না। যুদ্ধাপরাধের যে রায় কার্যকর হয়েছে সেটা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যেমে- তাই সেই রায়ের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।
ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, বিপিএলে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটার অংশ নিয়েছেন, জিম্বাবুয়ে ক্রিক্রেট দল খেলল, অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দল খেলে গেল- কই কোনো সমস্যা তো হল না? আসলে সত্য কথাটা হল- নিরাপত্তার অজুহাত তোলাটা এক ধরনের বিদেশী ষড়যন্ত্র। কারণ বিশ্বের বড় বড় দেশ চায় না বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। তাই তারা বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করছে, যা এক ধরনের বর্ণবাদী আচরণ বলেই আমি মনে করি।
উল্লেখ্য, বিচ্ছিন্নভাবে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি যথেষ্ট স্থিতিশীল। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের রানী ম্যাক্সিমা বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তিনি শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতিসংঘ মহাসচিবের উন্নয়নের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন বিষয়ক অ্যাডভোকেট হিসেবে এ সফর করেন। তারপর ঢাকায় খুবই সুষ্ঠুভাবে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী কিংবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যোগ দেন। বাংলাদেশে এখন চলছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল)। জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলিউড তারকা ঋত্বিক রোশনসহ অনেক বিদেশী শিল্পী অংশ নেন। বিপিএলের মোট ছয়টি দলের প্রতিটি দলে কমপক্ষে চারজন করে বিদেশী ক্রিকেটার অন্তর্ভুক্ত রাখা বাধ্যতামূলক। অনেক দলে চারজনের চেয়েও বেশি বিদেশী খেলছেন। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে চলছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শাস্ত্রীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। এর আগে পৃথক দুটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসব হয়েছে। এ দুটি উৎসব হল লোকজ উৎসব- ইন্টারন্যাশনাল লিট ফেস্ট ও ফোক ফেস্ট। এছাড়া চট্টগ্রামে হয়েছে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট। অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল দল বাংলাদেশ সফর করেছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, কোনো একটা ঘটনার পরপর যেভাবে দেশের বাইরে থেকে বিবৃতি দেয়া হচ্ছে তা দেখে মনে হচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী এতে উৎসাহ পাচ্ছে। তার কারণ, যারা বিবৃতি দিচ্ছে বা যেখান থেকে বিবৃতি আসছে জঙ্গি তাদেরই সৃষ্টি। আইএস বলি বা আল কায়দা বলি সব তাদের এক ধরনের কৌশল। তিনি বলেন, পৃথিবীর যে দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে এবং মার্কিন স্বার্থ জড়িত আছে সেখানে আল কায়দা বা আইএসের  তৎপরতার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা হচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। এই নতুন আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় কোনো কোনো মহল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। যার অংশ হিসেবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আইএস আছে। এর মাধ্যমে কোনো কোনো গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সরকার সবকিছু আঁচ করতে পেরে নিজেদের সুমন্নত রাখতে কৌশল গ্রহণ করেছে।
জেনারেল আবদুর রশীদ আরও বলেন, আইএস বা জঙ্গিবিরোধী ভূমিকায় পশ্চিমা বিশ্ব ও মার্কিনিদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তারা জঙ্গি মোকাবেলার নামে যে কথা বলত, সেটার বিশ্বস্ততা হারিয়ে গেছে। সিরিয়া বা ইরাকে যেভাবে পরাশক্তির খেলা চলছে তা দেখেই পশ্চিমা বিশ্বের জঙ্গিবিরোধী ভূমিকা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার অসাম্প্রদায়িক ও সহিষ্ণু সমাজকে ধরে রাখতে চেষ্টা করছে। সরকার সেটা পেরেছেও। কিন্তু এ দেশে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত নানাভাবে আন্তর্জাতিক মহলে যোগসূত্র তৈরি করে ছক করেছে। সেই ছক অনুযায়ী এ দেশকে অকার্যক্রর করার চেষ্টা চলছে। তবে সেটা সফল হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.