মসজিদে আজান হয় না নামাজ বন্ধ by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

পবিত্র রমজান মাস। পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য এ মাসে বাড়তি আমল-ইবাদত করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। কিন্তু সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে সব যেন থমকে আছে। আজান শুনে নয়, রোজা ভাঙতে হচ্ছে ঘড়ি দেখে। সেহরিও খেতে হচ্ছে ঘড়ি দেখে, মসজিদ থেকে কোন ঘোষণা আসে না। কারণ তালা দেয়া মসজিদে আজান হয় না, নামাজও বন্ধ আছে। দুই পক্ষের বিরোধের জেরে ৪ঠা জুলাই থেকে জকিগঞ্জের হালঘাট জামে মসজিদে আজান-নামাজ সবই বন্ধ আছে। তবে এর আগে ঘটে আরও এক নাটক। যা গড়ায় থানা পুলিশ পর্যন্ত।
আজান-নামাজ নিয়ে এমন ‘কানামাছি’ হালঘাট জামে মসজিদে নতুন নয়। চলতি বছরেই এ নিয়ে তিন দফা বন্ধ হলো আজান ও নামাজ। গত মার্চ মাসে মসজিদের মাওলানা কামাল উদ্দিন বিদায় নিলে ১৫/১৬ দিন মসজিদে কোন আজান হয়নি, নামাজও হয়নি। কামাল উদ্দিন মসজিদ ছেড়েছিলেন কোন উপায়ন্তর না দেখেই। দরিদ্র এ মাওলানা মাসিক তিন হাজার টাকা বেতন ও গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে খাওয়ার ব্যবস্থার বিনিময়ে এ মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হয়েছিলেন। খাবার পেলেও বেতন ঠিকঠাক মতো পাচ্ছিলেন না কামাল উদ্দিন। স্ত্রী ও তিন সন্তানের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। তাই মসজিদ ছেড়ে যান। তবে কথা দেন, বেতনের ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে তিনি আবার ফিরে আসবেন। ফিরে এসেছিলেনও। রমজান শুরুর তিন দিন আগে মাওলানা কামাল উদ্দিনকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় মসজিদের ইমাম হিসেবে। তিনি ফিরে আসার আগে আরও ১৫/১৬ দিন মসজিদে তালা ঝুলে ছিল। এমনকি পবিত্র শবেবরাতের রাতেও মসজিদ বন্ধ ছিল। নামাজ-আজান হয়নি। ‘চারিত্রিক স্খলনে’র অভিযোগে মাওলানা কামাল উদ্দিনের পর নিয়োগ পাওয়া ইমাম মাওলানা মাসুম আহমদকে অব্যাহতি দেওয়ায়ই মসজিদে এমন অচলাবস্থা নেমে এসেছিল। পরে গ্রামের মানুষের চাপের মুখে মসজিদের কোষাধ্যক্ষ আবদুল মতিন আগের ইমাম মাওলানা কামাল উদ্দিনকে ফিরে আসার অনুরোধ করেন।
নাটকের আরও যেন বাকি ছিল। ৪ঠা জুলাই ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদের ভেতর ঘুমিয়ে ছিলেন মসজিদের ইমাম মাওলানা কামাল উদ্দিন। সকাল ৮টার দিকে প্রতিদিনের মতো গ্রামের শিশুরা মসজিদে পড়তে এসে দেখে মসজিদ বাইরে থেকে তালা দেয়া। ভেতরে বন্দি ইমাম সাহেব। পরে খবর পেয়ে জকিগঞ্জ থানা পুলিশ এসে তালা কেটে উদ্ধার করে মসজিদের ইমামকে। নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়িতে উঠিয়ে তাকে থানায় নিয়ে যায়।
মসজিদ নিয়ে এমন ছেলেখেলার নেপথ্যে রয়েছে গোষ্ঠী বিরোধ, যার শুরু ২০০৭ সাল থেকে- মানবজমিনের অনুসন্ধান এমনটিই বলছে। ২০০৭ সালে হালঘাট গ্রামের জনৈক হোসেন আহমদ বিদেশ যাত্রা উপলক্ষে তার টাকা ও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা রাখেন গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী খলিলুর রহমানের কাছে। এরই সূত্রে গ্রামের বাসিন্দা আবদুল বাসিত ও আছাব আলীসহ কয়েকজনের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে খলিলুর রহমানের। এ নিয়ে সালিশ বৈঠকও হয়। কিন্তু কোন কিনারা না হওয়ায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০০৮ সালের ১২ই এপ্রিল মামলা ঠুকেন ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। মামলায় আবদুল বাসিত এবং আছাব আলীর দুই ছেলে ইসমাইল ও আলী হোসেনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। খলিলুর রহমানের ভাতিজা আবদুল মতিনই এখন হালঘাট জামে মসজিদের কোষাধ্যক্ষ। পুরনো বিরোধের কারণে তাকে মানতে চাইছেন না আবদুল বাসিত ও আছাব আলীর গোষ্ঠীর লোকেরা। মূলত এ বিরোধের কারণেই মসজিদে ইমাম নিয়োগ-অব্যাহতির খেলা চলছে। যার ফলে বারেবারেই মসজিদে তালা ঝুলছে, বন্ধ হচ্ছে নামাজ-আজান।
সর্বশেষ ইমাম কামাল উদ্দিনকে আটকে রেখে মসজিদে তালা ঝুলানোর পর পুলিশ দু’পক্ষকেই থানায় ডেকেছিল। আবদুল বাসিত ও আছাব আলীর গোষ্ঠীর লোকজন তাতে সাড়া দেননি। এমতাবস্থায় মসজিদ কমিটিকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয় থানা থেকে। কিন্তু কে মসজিদে তালা দিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পাওয়ায় ৮ই জুলাই পর্যন্ত সময় চায়  মসজিদ কমিটি। এরই মাঝে ৬ই জুলাই আছাব আলীর ভাই ইব্রাহিম আলী ইমাম সাহেবকে তালাবদ্ধ করার ঘটনায় থানায় একটি অভিযোগ দেন। এতে তিনি মসজিদের কোষাধ্যক্ষ আবদুল মতিন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল মান্নানকে অভিযুক্ত করেন।
জকিগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) শওকত হোসেন মানবজমিনকে বলেন, হালঘাট মসজিদে ইমামকে আটকে রাখার ঘটনায় অভিযোগ এলেও এ পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.