গাড়ির ওপর ক্ষোভ কেন? by আবদুর রশিদ

৬ জুলাই মারধরের শিকার হন তিতুমীর কলেজের
ছাত্রলীগের দুই কর্মী। এর জের ধরে তাঁদের তাণ্ডব
প্রতিরোধে রাস্তায় নামেন এলাকাবাসী । কলেজের
সামনে পুলিশি পাহারা (ইনসেটে) l ছবি: প্রথম আলো
ছাত্র সংগঠনের সব ক্ষোভ যেন রাস্তার গাড়ি আর স্থানীয় দোকান পাটের ওপর। সংগঠনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল? এলাকায় আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ? দলে কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়ায় ক্ষোভ?—এই সব কিছু ঘিরে যে সহিংস অবস্থা তৈরি হয় তার প্রথম শিকার হয় রাস্তার গাড়ি ও স্থানীয় দোকান-পাট। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ সংলগ্ন এলাকাগুলোতে মানুষকে চলতে হচ্ছে আতঙ্ক নিয়ে।
জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন প্রতিক্রিয়া দেখানোর ধরন বদলে গেছে। বহু বছর ধরে কিছু হলেই গাড়ি-দোকানপাট ভাঙার ঘটনা ঘটছে। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, অন্যান্য দেশেও হয়। আসলে যখন একটি জায়গায় অনেক মানুষের সমাগম ঘটে, তখন তাদের ওপর কারওরই নিয়ন্ত্রণ থাকে না। একজন একটি কাজ করলে, সবাই তাকে অনুসরণ করে। অধিক মানুষ বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়ায় তাদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয় না।’
গত ৬ জুলাই সরকারি তিতুমীর কলেজে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে এলাকাবাসী মারধর করেছে—এমন অভিযোগে কলেজের সামনের রাস্তায় অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন ওই কলেজের ছাত্রলীগ কর্মীরা। স্থানীয় দোকানপাট ও হকারদের দোকানও গুঁড়িয়ে দেন তাঁরা। কিন্তু কেন গাড়ি কিংবা দোকান ভাঙচুর হয়েছে সেটা তাঁদের অনেকেই জানতেন না।
ভাঙচুরের শিকার হওয়া একটি গাড়ির মালিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ওই এলাকায় থাকেন। তাঁর গাড়ি তিতুমীর কলেজ এলাকায় আসা মাত্রই ভাঙচুর করে ছাত্রলীগ। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তিনি কাউকে নিবৃত্ত করতে পারেননি।
ওই দিন তিতুমীর কলেজের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে ডিম, কলা ও শসার দোকান নিয়ে বসে ছিলেন বৃদ্ধ বাহার মিয়া। তিনি বলেন, মারামারি চলার সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা তাঁর দোকানের সব ডিম ভেঙে ফেলেন, কলাগুলো কেটে রাস্তা ফেলে দেন। অন্য দোকানিরা দ্রুত তাঁদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকেন। এরপর ছাত্রলীগের তিতুমীর কলেজ শাখার সভাপতি কাজী মিরাজুল ইসলাম (ডলার) ও সাধারণ সম্পাদক মানিক হোসেনের নেতৃত্বে গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
তিতুমীর কলেজের সামনের দুজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ৬ জুলাই ছাত্রলীগ যা ঘটিয়েছে তাতে সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা কোনো সরকারি যানবাহন ভাঙেনি। তারা যে সব গাড়ি ভেঙেছে তা সাধারণ মানুষেরই। আর পুলিশ এসেছে ঘটনার অনেক পরে। এর আগে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে।
আজ বুধবার তিতুমীর কলেজের গেটে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। স্থানীয় লোকজন যেন কলেজের দখল না নিতে পারে এ জন্য গেটে তাঁরা পাহারা দিচ্ছিলেন। সেখানে ছাত্রলীগের এক কর্মীর কাছে এই প্রতিবেদক জিজ্ঞাসা করেন—‘সংঘর্ষ হয়েছে এলাকাবাসীর সঙ্গে, আপনারা রাস্তার গাড়ি ভেঙেছেন কেন? ’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমাদের এক কর্মীকে মারধরের পরে যখন প্রতিরোধ করতে এক জায়গায় জড়ো হই তখনই রাস্তায় ভাঙচুর করা হয়। এটা আমাদের অপরাধ বলতে পারেন।’
গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর তিতুমীর কলেজ ও মিরপুরের বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে পদ না পেয়ে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙচুর চালায়। তিতুমীর কলেজের কমিটিতে পদ না পেয়ে আগের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন চৌধুরী ও জাহিদুল ইসলাম কিছু কর্মী নিয়ে প্রথমে কলেজগেটে বিক্ষোভ করে। পরে তারা রাস্তায় নেমে দেড় শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করে। অন্যদিকে মিরপুর বাঙলা কলেজে কমিটিতে পদ না পেয়ে রাস্তার গাড়ি ভাঙচুর করেন ছাত্রলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম (শান্ত) ও মো. সুমনের কর্মীরা।
পদ দেয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, সাধারণ মানুষের গাড়ির ওপর ক্ষোভ কেন?—জানতে চাইলে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ‘রাস্তায় লাঠি নিয়ে নামলে মাথায় কাজ করে না। সামনে যা পাই, তাই ভাঙ্গি।’
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নাসরীন বলেন, তাদের বুঝতে হবে, এ ঘটনার জন্য রাস্তার গাড়ি দায়ী নয়। যারা সংশ্লিষ্ট তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রে সবারই নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবাইকে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।’
তিতুমীর কলেজের সামনের রাস্তার গাড়ি ভাঙার ঘটনার বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই কলেজের মাঠের দখল ও শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন ও রাব্বির অনুসারী স্থানীয় লোকজন। এ নিয়ে প্রায়ই কলেজ ছাত্রলীগের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থক সংগঠনের বাগ্‌বিতণ্ডা ও সংঘর্ষ হয়। কিছু হলেই ছাত্রলীগ এসে রাস্তায় অবস্থান নেয়, আর স্থানীয়রা তাদের এলাকায় চলে যায়। কাউকে না পেয়ে রাস্তার গাড়ির ওপর ক্ষোভ মেটায় তারা।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রথমে আলোকে বলেন, ‘যাঁর মধ্যে ন্যূনতম শিক্ষা আছে, সে কখনো এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করতে পারে না। কারণ ঘটনার জন্য তো গাড়ি কিংবা দোকানপাট দায়ী নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে নয়—এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য সংগঠনের স্ব স্ব ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সক্রিয় হতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.