সালেহও চলে গেল

সালেহও চলে গেল। অনেকটা নীরবেই। মোহাইমেন সালেহর কথা বলছি। আটাবের দুবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সায়মন সেন্টারের কর্ণধার। বীর মুক্তিযোদ্ধা। সমাজসেবক। দানবীর হিসেবে খ্যাত। মৌলভীবাজারের জুরী এলাকা থেকে এমপি হওয়ারও ইচ্ছা ছিল। মনোনয়ন দৌড়ে পেরে ওঠেনি। প্রয়াত জিল্লুর রহমান সাহেব কথা দিয়েও শেষ অব্দি মনোনয়ন দিতে পারেননি। সে অন্য কথা। বরাবর সে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। সালেহ আমার বন্ধু। শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে। আমার জানি দোস্ত। কলেজ জীবনের সহপাঠী ছিল। এক রুমেই কাটিয়েছি অনেক দিন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আবাসিক সুবিধা না থাকায় মৌলভীবাজার কলেজে ভর্তি হতে হয়েছিল। হোস্টেলে থাকবো। তারিখটা ঠিক এ মুহূর্তে মনে নেই। তবে দিনটি ছিল সোমবার। হোস্টেলে আমার নামে সিট বরাদ্দ হয়েছে। রুম দেখতে গিয়ে পেয়ে গেলাম এনামকে। একটু পরে এলো সালেহ। পরিচিত হলাম। এনামও ব্যবসায়ী ছিল। সিলেটের জিন্দাবাজারের হক ট্রেডার্সের মালিক। প্রথম দিনেই সালেহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। পরে ভাল বন্ধু। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে গেলাম দুজন। বলা চলে স্রোতের বিপরীতে। মৌলভীবাজার কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের দাপট এতটা বেশি ছিল ছাত্রলীগকে খুঁজেই পাওয়া যেত না। আমরা ছাত্রলীগে যোগ দিলাম। ভাল ছাত্র ছিল সালেহ। আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। ও পড়াশোনার দিকেই অধিক মাত্রায় ঝুঁকে থাকলো। দীর্ঘ ইতিহাস। আমি কলেজের ভিপিও হয়ে গেলাম। ছাত্রলীগ থেকে প্রথম ভিপি। যদিও কেবিনেটের বেশির ভাগ সদস্য ছাত্র ইউনিয়নের। কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিল। সালেহ চলে গেল চট্টগ্রামে। আমি চলে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় এলেই দেখা হতো। আমার ঠিকানা তখন দৈনিক বাংলার বাণী। পুরোদস্তুর সাংবাদিক হয়ে গেছি। আর এটা ছিল 
প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মণির একান্ত ইচ্ছায়। তিনি বলতেন, কমিউনিস্টরা সাংবাদিকতা দখল করে রেখেছে। দখলমুক্ত করতে হবে। আজ তিনি বেঁচে থাকলে দেখতেন দখলমুক্ত নয়, পুরো কবজায় এসে গেছে। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা না বললেই নয়। ২৬শে মার্চ সকালে সড়কে ব্যারিকেড দেয়া অবস্থায় আমি গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম পাকবাহিনীর হাতে। সাত বন্ধুকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করলো পাকবাহিনী। চারজনকে মনু নদীর সেতুর ওপর দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করলো। কি করে যে বেঁচে আছি তা বিস্ময়কর। যাই হোক সে অন্য প্রসঙ্গ। সালেহ মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল। রাজনীতি কি ছাড়া যায়। আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক হলাম। হঠাৎ করে দেখি একদিন সালেহর চিঠি। অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে, তোমার এই স্বীকৃতিতে আমরা গর্বিত। বলতে গেলে আমাদের কমিটির নেতারাই এখন দেশ চালাচ্ছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ওবায়দুল কাদের, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, খ. ম. জাহাঙ্গীর, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও ওবায়দুল মুক্তাদির রবিউল আলমের কথা বলতেই হয়। এখন এরা সবাই আওয়ামী লীগে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। আশরাফ তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওবায়দুল কাদের জাঁদরেল মন্ত্রী। রবিউল ও খ. ম. জাহাঙ্গীর এমপি। মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সাবেক এমপি। সালেহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ঢাকায় এলো। শুরু করলো ব্যবসা। ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায় স্বল্প সময়ের মধ্যে খ্যাতি পেয়ে গেল। ভাল কিছু হলেই ডাক পড়তো আমার। বিদেশেও ভ্রমণ করেছি একসঙ্গে একাধিকবার। অনেক দিন অসুস্থ ছিল। হার্টের সমস্যা। বাইপাস হলো। তাতেও সে দমবার পাত্র নয়। মার্কিন ভিসা সেন্টারের উদ্বোধন হবে। চিঠি পেলাম। ফোনেও বললো হাজির থাকতে হবে কিন্তু। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা উপস্থিত থাকবেন। ড্যান আমার বন্ধু সে জানতো। দিনটা ছিল ৮ই নভেম্বর ২০১৪। বিকাল ৩টায় উদ্বোধন হবে। আমাকে বললো দেশে একটা রেস্টুরেন্ট করেছে সায়মন সেন্টারের ওপরে। দুপুরের খাওয়াটা একসঙ্গে খাবো। হাজির হলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ। সময় হলো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আসার। আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে ওপরতলায় পৌঁছালাম। সালেহ নিচে অপেক্ষা করছে। রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে লিফটে ওঠার মুহূর্তে বিদ্যুৎ চলে গেল। চিকিৎসকের বারণ সত্ত্বেও সে হেঁটে ওঠার চেষ্টা করলো। অল্প দূর যেতেই অসুস্থ হয়ে পড়লো। এরপর নিয়ে যাওয়া হলো ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখান থেকে কিছুদিন পর ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হসপিটালে। আবার ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখান থেকেই চলে গেল না ফেরার দেশে। দুঃখ কি হাসিমাখা মুখটাও দেখতে পেলাম না। বলতে পারলাম না ক্ষমা করিস বন্ধু।
মতিউর রহমান চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.