২০ বছর পর বাড়ল ভূমি উন্নয়ন কর by এম এ বাবর

ভূমি উন্নয়ন করসহ বিভিন্ন ফি বাড়িয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। চলতি মাস (জুলাই’ ১৫) থেকেই নতুন কর হার কার্যকর হবে এবং এর আগে ১৯৯৫ সালের ৩০ মে জারি করা এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়েছে। খাস জমি ছাড়া সব সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, পরিবার বা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রে ভূমি উন্নয়ন কর প্রযোজ্য হবে। আর নতুন কর হার অনুযায়ী কোনো জমি ব্যবহারের প্রকৃতি পরিবর্তন হলে জমির মালিককে নিজ উদ্যোগে এসি ল্যান্ড অফিসে গিয়ে কর পুনর্নির্ধারণ করে নিতে হবে। এ সংক্রান্ত আবেদন পাওয়ার পর সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ৪৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি পাঁচ বছর পর কর ও ফি পুনর্নির্ধারণ করা উচিত। কারণ তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এই মুহূর্তে নামজারি, দাখিলা, জাবেদা নকলসহ বিভিন্ন খাতে সরকার যে ফি পায় তা দিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক আয় পাঁচশ’ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু খরচ প্রায় সোয়া ছয়শ’ কোটি টাকা। তাই সেবার মান উন্নয়নে ভূমি কর পুনর্নির্ধারণ করা করাই যুক্তিসঙ্গত।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারি করা নতুন প্রজ্ঞাপন সূত্রে জানা গেছে, হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন করে ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমি করের আওতামুক্ত থাকলেও বেড়েছে অন্যান্য খাতের জমির কর। জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে কৃষি ও অকৃষি জমির জন্য পৃথকভাবে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষিজমির ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক কৃষিজমির পরিমাণ ২৫ বিঘা (৮ দশমিক ২৫ একর) হলে কোনো ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে না। বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ ছাড়া এই মওকুফের আওতায় আখ ও লবণ চাষ এবং কৃষকের পুকুরের জমি আওতামুক্ত থাকবে। তবে ২৫ বিঘার ওপরে হলে বা কোনো সংস্থা কর্তৃক যে কোনো পরিমাণ কৃষিজমি অধিকৃত হলে (সংস্থা বলতে সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ বা দখলে কৃষিজমি), অথবা চা, কফি, রাবার, ফুল-ফলের বাগান, বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ, চিংড়ি চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামার ইত্যাদি বিশেষ কাজে ভূমি ব্যবহার করলে ভূমির পরিমাণ যাই হোক না কেন, প্রতি শতকে বছরে ২ টাকা হারে কর দিতে হবে। আর এই কৃষিজমি গ্রামে বা পৌর এলাকা কিংবা যেখানেই হোক না কেন, সব স্থানেই একই শর্ত প্রযোজ্য হবে। এছাড়া যেসব জমি ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফের আওতায় থাকবে সংশ্লিষ্ট জমির প্রতিটি হোল্ডিংয়ের ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ বাবদ দাখিলা প্রদানের জন্য জমির মালিকের কাছ থেকে বার্ষিক ১০ টাকা আদায় করতে হবে। ১৯৯৫ সালের প্রজ্ঞাপনে শুধু ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমি করের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু উল্লিখিত দিকনির্দেশনার কিছুই ছিল না।
এদিকে অকৃষি জমির ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণে এলাকাভিত্তিক ছয়টি ধাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘ক’ ধাপে রয়েছে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনভুক্ত এলাকা। এখানে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর প্রতি শতকে তিনশ’ টাকা, শিল্প কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর দেড়শ’ টাকা এবং আবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘খ’ ধাপে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনভুক্ত এলাকা। ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলা, সাভার, ধামরাই, চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী ও কক্সবাজার জেলা সদরের পৌর এলাকা। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো পৌর এলাকা এবং সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর ও মেঘনাঘাট এলাকা। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি, জামিরদিয়া, ধানসুর, ভানডাব, কাঁঠালি ও মেহেরবাড়ি মৌজা। নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী পৌর এলাকা। এছাড়া রয়েছে রাজউকের আওতাধীন পূর্বাচল আবাসিক এলাকা। এখানে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর প্রতি শতকে ২৫০ টাকা, শিল্প কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ১৫০ টাকা এবং আবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘গ’ ধাপে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, নোয়াখালী, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, কৃষ্টিয়া, যশোর ও পটুয়াখালী জেলা সদরের পৌর এলাকা। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার আটরা গিলাতলা ইউনিয়ন ও দামোদর ইউনিয়নের মশিখালী মৌজা। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন পৌর এলাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ, কুমিল্লা জেলার লাকসাম ও চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলা। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা পৌর এলাকা এবং টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর পৌর এলাকা। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পৌরসভা। এছাড়া রয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরববাজার পৌর এলাকা। এখানে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর প্রতি শতকে দুইশ’ টাকা, শিল্প কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ১২৫ টাকা এবং আবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘ঘ’ ধাপে অন্যান্য জেলা সদরের পৌর এলাকা। অন্যান্য সব প্রথম শ্রেণীর পৌর এলাকা। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি ও চাটখিল পৌর এলাকা এবং লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ ও রায়পুর পৌর এলাকা। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়ন। বগুড়া জেলার শান্তাহার পৌর এলাকা ও শেরপুর পৌর এলাকা। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি পৌর এলাকা এবং পাবনা জেলার ঈশ্বরদী পৌর এলাকা। খুলনা জেলার দীঘলিয়া উপজেলার যৌগীপুর ইউনিয়ন ও আড়ংঘাটা ইউনিয়ন, বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়ন, ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়ন এবং যশোর জেলার অভয়নগর পৌরসভা। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর পৌরসভা। এছাড়া এই ধাপে রয়েছে নোয়াখালী জেলার বশুরহাট পৌর এলাকা। এখানে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর প্রতি শতকে একশ’ টাকা, শিল্প কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ৭৫ টাকা এবং আবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘ঙ’ ধাপে অন্য সব পৌর এলাকা। এখানে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর প্রতি শতকে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ টাকা, শিল্পকাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ৪০ টাকা এবং আবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘চ’ ধাপে পৌর এলাকা ঘোষিত হয়নি এমন এলাকা ভূমি উন্নয়ন করের আওতায় আসবে। এখানে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর প্রতি শতকে ৪০ টাকা, শিল্পকাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ৩০ টাকা এবং আবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, ভূমি উন্নয়ন কর আদায়যোগ্য কোনো জমির পরিমাণে শতকের ভগ্নাংশ থাকলে তা পরবর্তী পূর্ণ শতক ধরে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারিত হবে। এছাড়া সার্বিকভাবে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে নিজ উদ্যোগে এলাকা পরিদর্শন করে ভূমি ব্যবহারের প্রকৃত ধরন অনুযায়ী প্রযোজ্য হারে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে। ভূমি ব্যবহারের প্রকৃতি পরিবর্তনের কারণে ভূমি উন্নয়ন কর পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইউনিয়ন বা পৌর ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) অবহিত করে অনুমোদন নিতে হবে। কোনো জমি ব্যবহারের প্রকৃতি পরিবর্তন হলে জমির মালিককে নিজ উদ্যোগে এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। আর কেউ এসি ল্যান্ডের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে তিনি সংশ্লিষ্ট জেলার এডিসি (রাজস্ব) বরাবর আপিল করতে পারবেন। একইভাবে তিনি যদি এডিসির সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হন তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আপিল করতে পারবেন। এরপর কেউ চাইলে বিভাগীয় কমিশনারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভূমি আপিল বোর্ডেও যেতে পারবেন। ভূমি আপিল বোর্ডকে এ ধরনের কেস একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.