ঈদকে সামনে রেখে বেনারসি পল্লীর শ্রমিকদের নির্ঘুম রাত by জাভেদ ইকবাল

এগিয়ে আসছে ঈদ। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে বেনারসি পল্লীর শ্রমিকরা। তাঁতের খটখট শব্দে চলছে শাড়ি বানানোর কাজ। রাতদিন যেন একাকার হয়ে গেছে। রংপুরের বেনারসি পল্লী সরব। এ শিল্পের উন্নয়নে আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)। সরকারের এ সহযোগিতা পেয়ে নতুন করে বাস্তবায়নের রূপ নিয়েছে প্রকল্পটি।
সরজমিন অনুসন্ধানকালে জানা যায়, এক সময় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তালকু হাবু গ্রামের বেনারসি পল্লীর নাম ছিল দেশময়। ২০০৫ সালে প্রায় ১০০ তাঁতি ওই এলাকায় বেনারসিপল্লী গড়ে তোলে। এখানকার পণ্যের মান ছিল দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক ভাল। বিপণন ও আর্থিক সমস্যার কারণে এক সময় মুখ থুবড়ে পড়ে এ শিল্প। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় বেশির ভাগ কারখানা। বেকার হয়ে পড়েন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫০০ কারিগর। তাদের কথা চিন্তা করেই এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে সরকার উদ্যোগ নেয়। এ জন্য সরকার ২ কোটি ৩৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। এ টাকা দিয়ে ৪০টি তাঁত বসানো হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের চাহিদা ও রুচির প্রতি নজর রেখে কারিগরদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এরপর তারাই অত্যাধুনিক বেনারসি শাড়ি ও অন্যান্য কাপড় তৈরি করছেন। তাঁতের খট খট শব্দে এখন মুখর হয়ে উঠছে বেনারসি পল্লীর পরিবেশ। সূত্রটি আরও জানায়, তাঁত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ কাজ শুরু হয়েছে। তাঁত মালিকদের সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে। ওই এলাকায় ৬৭টি পরিবারের মধ্যে সমন্বয় করে তাঁত স্থাপনের জন্য ৬৮০ বর্গফুট আয়তনের ৪০টি শেড নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়েছে। সেগুলোতে চলছে বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ। এরপর সেখানেই থাকছে বেনারসি শাড়ির প্রদর্শনী কেন্দ্র। তাঁত মালিক রোস্তম মিয়া জানান, এক সময় তার নিজের ৩০টি তাঁত ছিল। পুঁজি সংকট, কাঁচামাল এবং বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে সব বন্ধ হয়ে যায়। এখন তিনি নিঃস্ব। সরকার এ শিল্পের দিকে নজর দেয়ায় আবার শিল্পটি ঘুরে দাঁড়িযেছে। বেনারসি তৈরির কাজে মুখরিত হয়ে উঠছে পুরো এলাকা।  গঙ্গাচড়ার তালুক হাবু এলাকার রহমান উইভিং তাঁত শিল্পের মালিক ফরিদা আখতারের কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে কারিগরদের তাঁত চালানোর খুটখাট শব্দ। তাদের এদিক সেদিক তাকানোর যেন সময় নেই। ওই কারখানায় কথা হয়, কারিগর রোস্তম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ঈদকে সামনে রেখে বেনারসি শাড়ির চাহিদা বেড়ে গেছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। এ কারণে আমাদের রাতদিন কাজ করতে হচ্ছে। কারিগর রেশমা জানান, ভাই এখন কথা বলার সময় নেই। তিনি জানান, এখানে আমরা তৈরি করছি বুটি জামে বাহার, বেলবুটি, সাটান, নকশি, ফুলকলিসহ বিভিন্ন প্রকাশের শাড়ি। এ কারখানার মালিক ফরিদা আখতার জানান, তার এখানে ৮টি তাঁত রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২৪ ঘণ্টাই চলছে কাজ। এক সপ্তাহে যেখানে ১৬টি শাড়ি তৈরি হতো সেখানে এখন ৩০টি শাড়ি হচ্ছে। এসব শাড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অভিজাত বিপণি বিতানে সরবরাহ করা হচ্ছে। একই এলাকার নিশাত বেনারসি ফ্যাক্টরির মালিক কুদ্দুস মিয়া জানান, এখানকার বেনারসি পল্লী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এতে করে এ অঞ্চলের বেকার লোকজনের বেকারত্ব দূর হবে। এ এলাকার নামও ছড়িয়ে পড়বে দেশ-বিদেশে। তার তাঁত রয়েছে ২০টি।  প্রশিক্ষণার্থী লক্ষিটারি ইউনিয়নের আমেনা, মোহসেনা, ফাতেমা এবং কবিতা বেগম জানান, বেনারসি শাড়িসহ অন্যান্য কাপড় তৈরির জন্য ৬০ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এখন তারা বানাতে পারছেন বেনারসি শাড়ি। এতে করে তাদের বেকারত্ব ও দরিদ্রতা ঘুচবে। আনোয়ার ও ফরিদা জানান, একেকজন কারিগরের একেকটি শাড়ি তৈরি করতে তিন দিন থেকে চার দিন সময় লেগে যায়। একটি শাড়ি তৈরি বাবদ তাদের দেয়া হয় ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা। তাদের বানানো ওই শাড়িই বাজারে বিক্রি হয় ২ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নাসরিন জানায়, এক সময় বেকার ছিলাম। মাঝে মাঝে অন্যের জমিতে মজুরির কাজ করতাম। এতে অভাব অনটনের সংসারে ভালভাবে দুবেলা খাবারও জুটতো না। কিন্তু বেনারসির উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সংসার ভালই চলছে।

No comments

Powered by Blogger.