যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত খুনি কামালের সাজা মাফের প্রক্রিয়া চলছে by শাহীন করিম

বরিশালের বহুল আলোচিত ফৌজিয়া রহমান ওরফে চাঁপা হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি জহিরুল আলম ওরফে কামালের সাজা মওকুফের প্রক্রিয়া চলছে। অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত খুনি কামালকে মুক্ত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে তার ধনাঢ্য পরিবার। স্ত্রীর করা ওই সাজা মওকুফের আবেদনটি বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখান থেকে আবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর দফতর হয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি মিলেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে নিহত চাঁপার বৃদ্ধ মা ঝর্ণা বেগম মানবকণ্ঠের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘শুনেছি বিপুল অঙ্কের টাকা বিলিয়ে আমার মেয়ের খুনি কামালকে মুক্ত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে ওদের পরিবার। আশা করছি, সুপ্রিম কোর্টে প্রমাণিত এই খুনিকে মাফ করবেন না প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অসুস্থ হলে কারাগারেই চিকিৎসা নিচ্ছেন দণ্ডপ্রাপ্ত। তাই অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে এত বড় আসামি মাফ পেলে দেশে আইনের শাসন থাকবে না।
অন্যদিকে কামালের সাজা মাফ করা হলে বরিশালে ফের আন্দোলন গড়ে তোলা হতে পারে বলে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ও মহিলা আইনজীবী সমিতিসহ একাধিক সূত্র জানায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৯ সালের ১৮ অক্টোবর রাতে সরকারি ব্রজমোহন কলেজের (বিএম কলেজ) ছাত্রী ও গৃহবধূ ফৌজিয়া রহমান ওরফে চাঁপাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বরিশাল শহরের ফকিরবাড়ী সড়কের বাসায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। আসামি কামাল চাঁপার দেবর। তিনি বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ নম্বর সেলে রয়েছেন। কামাল বরিশালের ওষুধ কোম্পানি রেফকো ল্যাবরেটরিজের লিমিটেডের পরিচালক ছিলেন কামাল। চাঞ্চল্যকর চাঁপা হত্যার ঘটনা ওই সময় বরিশালে বিএম কলেজসহ সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদসহ সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২২ বছর পলাতক থাকার পর ২০১১ সালে কামাল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর আগে এ হত্যা মামলায় কামালকে দোষী হিসেবে অভিযুক্ত করে বরিশালের জজ কোর্টের দেয়া ৩০ বছর সাজা বহাল রাখে সুুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আসামি জহিরুল আলম কামালের অবশিষ্ট সাজা মওকুফের জন্য তার স্ত্রী জেসমিন জাহান রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। সূত্র জানায়, ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়, কামাল হƒদরোগেসহ কিছু জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য বারডেম হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর আগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে করোনারি এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে তিন পর্যায়ে তাকে আটটি রিং পরানো হয়। বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তার হƒৎপিণ্ডে আরো চারটি ব্লক রয়েছে। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য কামালকে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন।  
নিহত চাঁপার স্বজনরা জানান, কামালের স্ত্রীর ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয় তাদের সম্মতি দিয়ে বলেছে, জেসমিন জাহানের আবেদনের বক্তব্য কয়েদির মেডিকেল রিপোর্ট, চিকিৎসা প্রত্যয়নপত্র ও প্যাথলজির রিপোর্ট দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, জহিরুল আলম জটিল হƒদরোগে ভুগছেন এবং তার বর্তমান শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি সদয় ইচ্ছা পোষণ করলে তার ওপর আরোপিত দণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে অবশিষ্ট সাজা (কারাদণ্ড ও জরিমানা) মওকুফ করতে পারেন।
যোগাযোগ করা হলে চাঁপার ছোট ভাই আমিন এহসান মানবকণ্ঠকে বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত একজন খুনিকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারেন না। একইভাবে আইন মন্ত্রণালয় একজন খুনির সাজা মওকুফের পক্ষে সম্মতি দিতে পারে না। তিনি বলেন, বিষয় জেনে আমরা ইতিমধ্যে ঢাকায় ও বরিশালে এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছি। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে বরিশালের মানুষকে নিয়ে ফের রাস্তায় নামব। তিনি বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি কামালের বয়স বর্তমানে ৪৬ বছর। তার সম্ভাব্য মুক্তির তারিখ ২০৩৭ সালের ১১ অক্টোবর। চাঁপার ভাই এহসান আরো বলেন, শুনেছি পূর্ব পরিচিত প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর তদবিরে এই সাজা কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার নথি ও নিহতের স্বজনদের সূত্র জানায়, গৃহবধূ চাঁপাকে তার দেবর কামাল, নাসির উদ্দিন জামাল ও ননদের স্বামী খন্দকার জিল্লুর বারী পরিবারের অন্যদের সহযোগিতায় হত্যা করেন। চাঁপার বেডরুম থেকে রক্তমাখা লোহার পাইপ, বাড়ির ছাদে বালতিতে রক্তমাখা একটি লুঙ্গিসহ অন্যান্য আলামত জব্দ করে পুলিশ। তখনই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে জহিরুল আলম কামাল, নাসির উদ্দিন জামাল, খন্দকার জিল্লুর বারীসহ ওই পরিবারের আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন বরিশাল কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা হয়। পরে মামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে তদন্তভার দেয়া হয় সিআইডির কাছে।
সূত্র জানায়, ১৯৮৯ সালের ১৬ নভেম্বর সিআইডি মামলাটির পুনঃতদন্ত করে ১৯৯০ সালের ২৭ মার্চ প্রথম এজাহারটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দ্বিতীয় এজাহার দেয় সিআইডি। ওই বছরের ২৪ মে কামালকে আসামি করে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে সিআইডি। ১৯৯৪ সালের ২৩ জানুয়ারি বরিশালের জজ আদালত চাঁপা হত্যার দায়ে কামালকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। পরে আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করলে হাইকোর্ট বিভাগ তাকে বেকসুর খালাস দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে আপিল বিভাগ আসামিকে ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।

No comments

Powered by Blogger.