সংযুক্তি চাই পানিরও -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : আ​মীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী by সোহরাব হাসান ও রাহীদ এজাজ

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
চারদেশীয় মোটরযান চুক্তির পর আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসানরাহীদ এজাজ
প্রথম আলো : চার দেশের মধ্যে সই হওয়া মোটরযান চলাচল চুক্তিকে কীভাবে দেখেন?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী : বিশ্বায়নের যুগে আঞ্চলিক সমৃদ্ধির সুফল পেতে হলে সংযুক্তির (কানেকটিভিটি) প্রয়োজন। এটি শুধু সড়কপথে হলে হবে না, সব মাধ্যমে হতে হবে। সংযুক্তি যেমন সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে হতে হবে, তেমনি বিদ্যুৎ-জ্বালানি, পানিরও অবাধ প্রবাহ বা সংযোগ জরুরি। অববাহিকাগত সহযোগিতার মাধ্যমে পানি ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা যায়, এর মাধ্যমে কীভাবে সব দেশ সুফল পেতে পারে, তা ভাবা উচিত। সড়ক সংযোগে হয়তো এক পক্ষ বেশি লাভবান হলো, অন্য সংযোগে আরেক পক্ষের লাভটা বেশি হবে। সব মিলিয়ে আঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যমে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে আন্তরিক চেষ্টা চালাতে হবে। এ অঞ্চলের সব অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সামনে মেকং নদী কমিশনের উদাহরণ রয়েছে। মেকং নদী অববাহিকার দেশগুলো নিজেদের পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে। সমস্যা মিটিয়ে ফেলেছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে অভিন্ন ৫৪টি নদী আছে, সেগুলোর জন্য একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থার দরকার। পণ্যের চলাচলের পাশাপাশি পুঁজি ও মানুষের চলাচলও হয়ে থাকে। সুতরাং, সংযুক্তিটা সামগ্রিক হতে হবে। আর কাজগুলো করতে হবে সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে। 
প্রথম আলো : এই যান চলাচল চুক্তি আঞ্চলিক বাণিজ্যে কতটা প্রভাব ফেলবে?
আমীর খসরু : আমি বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযোগিতার পক্ষে। একে চার দেশের, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সুফলটা আমরা পাব আংশিক, পুরোপুরি নয়। এখানেও সময়সীমা মাথায় রাখতে হবে। সড়কের পর সংযুক্তির বাকি ধাপগুলো কীভাবে হবে, সেটি ঠিক করতে হবে। যেমন নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগের সুযোগ আছে। ভারত ভুটান থেকে বিদ্যুৎ নিচ্ছে, আমরাও এ প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে পারি। আঞ্চলিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগের মাধ্যমে সব দেশ উপকৃত হতে পারে।
প্রথম আলো : বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই সংযুক্তির সুফল বাংলাদেশ কতটা পাবে, এ নিয়ে বিএনপির মূল্যায়ন কী?
আমীর খসরু : বিএনপি সব সময় আঞ্চলিক সহযোগিতার পক্ষে। এ জন্যই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সার্ক সৃষ্টি করেছিলেন। সার্ক নিয়ে তাঁর চিন্তা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন। আমরা খুশি যে নেহরুর দ্বিপক্ষীয় কূটনীতি থেকে বেরিয়ে এসে ভারত বহুমাত্রিক আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে।
প্রথম আলো : বিএনপি তো দুবার ক্ষমতায় ছিল। সে সময়ে এসব উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি কেন?
আমীর খসরু : বাংলাদেশ একা চাইলে তো পারবে না। আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য ভারতসহ অন্য সব দেশকেও এগিয়ে আসতে হবে। মোদি আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দিচ্ছেন, আগে তো ভারতের নীতিতে এটি ছিল না।
প্রথম আলো : বলা হচ্ছে, চারদেশীয় যান চলাচল চুক্তিতে ভারতের সুবিধা বেশি হবে। আপনি কি মনে করেন?
আমীর খসরু : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য অনেক সময় ও টাকা খরচ হয়। এখন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ওই অঞ্চলে পণ্য পরিবহনে ভারতের অনেক সাশ্রয় হবে, অর্থ ও সময় দুটোই। কাজেই চুক্তিতে ভারত লাভবান হবেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে। সুয়েজ খাল হওয়ার আগে আফ্রিকার দেশগুলোকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হতো। সুয়েজ খাল হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট হারে মাশুল ধরা হলো। প্রতিটি জাহাজকে ওই মাশুল দিতে হয়। সময় ও খরচের বিষয়টিকে বিবেচনায় এনে এই মাশুল ঠিক করা হয়েছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হলে নিজের পাওনাটাও বুঝে নিতে হবে।
প্রথম আলো : আপনি এখন সংযুক্তিকে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে নেওয়ার কথা বলছেন। অথচ বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের রুট নিয়ে অনেক সময় নষ্ট করেছেন।
আমীর খসরু : বিএনপি তো সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়েতে আমাদের প্রথম রুটটা টেকনাফ থেকে মিয়ানমার হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
প্রথম আলো : কিন্তু ভারত চেয়েছিল তামাবিল রুট হোক।
আমীর খসরু : ভারত তো চাইবেই। আমরা আমাদেরটা চাইব। আমরা যখন টেকনাফ হয়ে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়েতে যেতে পারছি, তখন কেন উত্তর-পূর্ব ভারতের জটিল ও দুর্গম পথ ভারত ঘুরে যাব?
প্রথম আলো : কিন্তু এই বিতর্কে আমরা সময় নষ্ট করেছি কি না?
আমীর খসরু : রুট ঠিক করার জন্য এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে রুটটি চালু করতে পারিনি তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে।
প্রথম আলো : এবার মোদির ঢাকা সফরের সময় কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভাড়ার বাইরে অন্য কোনো মাশুল ধরা হচ্ছে না। একবার মাশুল না নিলে পরে সব ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে কি না?
আমীর খসরু : দেখুন, মহাসড়কে চলাচলের জন্য আমরা টোল দিয়ে থাকি। আপনি যদি অবকাঠামো ব্যবহার করেন, তার জন্য তো আপনাকে পয়সা দিতে হবে। নাগরিকেরা যদি তাঁর দেশের অবকাঠামো ব্যবহারের জন্য পয়সা দেন, তবে অন্য দেশের লোকজন কেন দেবেন না! কাজেই ভারতের যাত্রীরাও বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহারের জন্য টোল দেবেন, এই নিয়মই হওয়া উচিত।
প্রথম আলো : মাশুলের বিষয়টি কীভাবে ফয়সালা হবে?
আমীর খসরু : সরকার নিজেই তো ট্যারিফ কমিশনকে দিয়ে এটি করিয়েছে। পরে কমিশনের ওই প্রতিবেদন তারা নেয়নি। এ ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। বিনিয়োগের কতটা, কীভাবে ফেরত পাব, সেটি দেখতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টিও দেখতে হবে।  চুক্তির বিষয়টি জনগণকে স্বচ্ছতার সঙ্গে জানাতে হবে। বিনিয়োগে আমার লাভ কী, এর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া কী সেসবও জনগণকে জানাতে হবে। সহযোগিতার জন্য একটি বিষয়ের সুরাহা করে বসে থাকলে চলবে না। নদীর পানি বণ্টনের সমস্যার সমাধান করতে হবে। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে।
প্রথম আলো : বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আদানি ও রিলায়েন্সকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এটিকে কীভাবে দেখেন?
আমীর খসরু : এখানে আইনের শাসন বড় বিষয়। দায়মুক্তি পুরোপুরি আইনের শাসনের বিরুদ্ধে। অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি—সবখানে দায়মুক্তি দিয়ে আমরা আইনের শাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। দায়মুক্তি সাময়িক সুফল আনে, কিন্তু তা টেকসই হয় না। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের সুবিধা দেওয়ার বেলায়ও ভারসাম্য রাখতে হবে।
প্রথম আলো : আপনি বাণিজ্যমন্ত্রী থাকতে ভারতের সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্টের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সফল হলেন না কেন?
আমীর খসরু : ভারত উন্নত দেশ আর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে তফাত ছিল, সেই জন্য এটি আর এগিয়ে নেওয়া যায়নি। তা ছাড়া এখন আঞ্চলিক উদ্যোগে ভারত যেভাবে সহযোগিতা করছে, তখন সেভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
প্রথম আলো : ভারতের প্রতি বিএনপির অবস্থান দৃশ্যত কি পরিবর্তন হয়েছে?
আমীর খসরু : ভারত কেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ সবার প্রতি বিএনপির নীতি অপরিবর্তনীয় রয়েছে। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের কথা ভেবে এগিয়ে চলার নীতি আমাদের। সুতরাং, বিশেষ কোনো দেশের প্রতি বেশি, কোনো দেশের প্রতি কম, এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রথম আলো : এটাই যদি হয়, তবে মোদির সফরের আগে কেন বিএনপি জোর দিয়ে বলেছে, ‘আমরা ভারতবিরোধী নই?’
আমীর খসরু : এক পক্ষ যেহেতু এ সফরকে রাজনৈতিক মূলধন হিসেবে প্রচার করেছে, তার জবাবেই বিএনপি এটা বলেছে। ভারতের কাছে সরকারের নিজেকে আরও ঘনিষ্ঠ করার যে চেষ্টা, সেটার জবাব দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি নিজে থেকে কিছু বলেনি।
প্রথম আলো : পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের চুক্তির সুফল কতটা আসবে?
আমীর খসরু : পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের সমাধান অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। কারণ বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য যায় সীমিত আকারে। ভারত থেকে পণ্য আসে বিপুল পরিমাণে। ভারত রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা না পেলেও বাংলাদেশ পাচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে অশুল্ক বাধার সমস্যা। বাণিজ্য বাড়াতে হলে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান জরুরি।
প্রথম আলো : বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চলের সুফল কীভাবে আসবে।
আমীর খসরু : বিনিয়োগ আমরা সব সময় চাই। বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। সেবা খাতের সুযোগ বাড়বে, রপ্তানিও বাড়বে।
প্রথম আলো : দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নতুন করে মাশুল নির্ধারণের কথা বলা হচ্ছে। এটিও কি সময়সীমা বেঁধে দিয়ে করা উচিত?
আমীর খসরু : এটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুরাহা করা উচিত। এটি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখলে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত  হবে। তবে ভারতের সঙ্গে বসার আগে বাংলাদেশকে এসব বিষয়ে নিজের অবস্থান ঠিক করতে হবে। কারণ সরকার ট্যারিফ কমিশনের প্রস্তাব মেনে নেয়নি। বিকল্প কী হবে সেটি তাহলে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। সবগুলো বিষয় জনসমক্ষে আনতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
আমীর খসরু : ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.