মেরিনা-সরোয়ারের বাঁধন ছিঁড়ে গেল! by সেলিম জাহিদ ও সফি খান

পেছনে ঘরগৃহস্থালি। চলে যাবেন ভারতে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী
থাকতে চান বাংলাদেশে। এক ছেলে নিয়ে তিনি এখন
বাবার বাড়িতে। আরেক ছেলেকে কোলে নিয়ে দাশিয়ার
ছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা সরোয়ার l সফি খান
ভারত, না বাংলাদেশ। একমত হতে পারলেন না দুজন। স্বামীর সিদ্ধান্ত ভারত, স্ত্রীর বাংলাদেশ। ভূখণ্ড বেছে নিতে দুই নাড়ির দুই টান। অবশেষে ভারত-বাংলাদেশে ভাগ হয়ে ছিঁড়ে গেল সরোয়ার আলম ও মেরিনা বেগমের দাম্পত্যের বাঁধন। এই দম্পতি ভারতের ১১১ ছিটমহলের একটি দাশিয়ার ছড়ার বাসিন্দা।
১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ কমিশন ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা ভাগ করেছিল। দেশভাগের ৬৮ বছর পর সেই সীমানা আর থাকছে না। আজ ৩১ জুলাই মধ্যরাতের পর ১৬২টি ছিটমহল দুই দেশের মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হচ্ছে।
দাশিয়ার ছড়া ছিটমহলটি ভারতের। এর অবস্থান বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার যে ১৬২টি ছিটমহল আছে, তার মধ্যে আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক থেকে এটি সবচেয়ে বড়। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী, এর আয়তন ১ হাজার ৬৪৩ একর। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে লোকসংখ্যা ৭ হাজার ১২৩ জন। অবশ্য ছিটমহলের বাসিন্দাদের দাবি, লোকসংখ্যা ১০ হাজার ২৭৮ জন। হেড কাউন্টিং বা জনগণনার সময় অনেকে ভয়ে নাম তোলেননি। মেরিনা ও সরোয়ার দাশিয়ার ছড়ার তিন নম্বর মৌজার বাসিন্দা।
কথা বলে জানা গেল, সরোয়ারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দাশিয়ার ছড়ায়। আর মেরিনার জন্ম বাংলাদেশে, কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুরে। ২০১১ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। তাঁদের ঘরে আছে দুই সন্তান মোস্তাফিজুর রহমান হিমেল ও আবদুল্লাহ আল মুয়াদ।
গত বুধবার বিকেলে দাশিয়ার ছড়ায় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কথা হয় সরোয়ার আলমের সঙ্গে। কোলে দুই বছরের ছেলে হিমেল। সরোয়ার জানান, তাঁদের চার ভাইয়ের দুজন পরিবার নিয়ে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পাশের খড়িবাড়ি বাজারের গত হাটে নিজের দুটি গরু ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। নিজের ভাগের কিছু গাছগাছড়া বেচে দিয়েছেন ২৮ হাজার টাকায়।
সরোয়ার বলেন, দুই ছেলে আর স্ত্রীসহ ৯ জুলাই ফুলবাড়ী উপজেলায় গিয়ে ভারতের অধিবাসী হওয়ার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পরে স্ত্রী মত পাল্টান। ২২ জুলাই স্ত্রী মেরিনা ছোট ছেলে মুয়াদকে নিয়ে বাবার বাড়ি ফুলবাড়ীর কাশিপুরে চলে যান।
প্রতিবেশীদের বক্তব্য, দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে স্ত্রীকে জোর করে রাজি করিয়েছিলেন সরোয়ার। তাই বিদায় নিতে যাওয়ার কথা বলে ছয় মাসের শিশুসন্তান মুয়াদকে নিয়ে বাবার বাড়ি যান। সেখান থেকে তিনি আত্মগোপন করেন। এর মধ্যে সরোয়ার জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী ২৭ জুলাই উপজেলায় গিয়ে নিজের ও দুই সন্তানের ভারতের যাওয়ার তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে এসেছেন। সরোয়ার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ পাননি।
ভারত, না বাংলাদেশ—ভিটেমাটি ছেড়ে ভূখণ্ড বেছে নেওয়ার এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এমন অনেক খণ্ড খণ্ড কষ্ট-যন্ত্রণা জমাট বেঁধেছে ছিটমহলগুলোতে। আবার এর ভেতরেই ঘুরে ফিরছে ৬৮ বছরের দীর্ঘ বঞ্চনা অবসানের আনন্দ। আজ শুক্রবার মধ্যরাতে ছিটমহলে নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণ। এই রাত ঘিরে চলছে উৎসবের নানা আয়োজন। যদিও ছিটমহলের বাইরে এ নিয়ে তেমন উৎসাহ বা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দাশিয়ার ছড়াসহ কুড়িগ্রাম জেলার ১২টি ছিটমহলের (একটিতে মানুষ নেই) জনসংখ্যা ৭ হাজার ১৩৬। এঁদের ৩১৭ জন ভারতে চলে যাওয়ার আবেদন করেছেন। এঁদের ১৫৮ জন হিন্দু, ১৫৯ জন মুসলমান। হিসাবে দেখা যায়, দাশিয়ার ছড়া থেকেই ২৮৪ জন ভারতে যাওয়ার আবেদন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫৮ জন হিন্দু, ১২৬ জন মুসলমান।
লক্ষ্মীবালা যাচ্ছেন, থাকছেন মধূসুদনরা: দাশিয়ার ছড়ার দুই নম্বর মৌজায় পাশাপাশি ঘর দুই ভাইবোন লক্ষ্মীবালা মোহন্ত ও মধূসুদন মোহন্তর। ৩৫ বছর ধরে এক বাড়িতে বসবাস তাঁদের। আরেক ভাই হরেকৃষ্ণ মোহন্তর বাড়ি তিন জমি পর। লক্ষ্মীবালার ছোট বোন যমুনা মোহন্ত আছেন সীমান্তের ওই পাড়ে ভারতের কোচবিহার জেলার নয়ারহাটে। সেখানেই তাঁর বিয়ে হয়েছে।
লক্ষ্মীবালার সিদ্ধান্ত, দুই ছেলে হরিচরণ ও বিষ্ণু মোহন্ত, ছেলের বউ আর পাঁচ নাতনিকে নিয়ে বোন যমুনার কাছাকাছি থাকবেন। মধূসুদন ও হরেকৃষ্ণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে থাকার।
ভারতের ছিটমহলের বাসিন্দা হলেও দুই ভাই আত্মীয়তা গড়েছেন বাংলাদেশিদের সঙ্গে। এর মধ্যে মধূসুদনের মেয়ে কৃষ্ণা রানীর বিয়ে দিয়েছেন লালমনিরহাটের বড়বাড়ি এলাকায়। ছেলে নরেশ ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করছেন।এত দিন পাশাপাশি থাকা বোন-ভাগনেরা ভিটে খালি করে চলে যাচ্ছেন ভারতে।
মধূসুদন মোহন্ত বলেন, ‘বাপ-দাদার জন্ম এই বাড়িতেই। ভিটা ছাড়ি কোটে যাম। বোনকে অনেক বুঝাইলাম, তারা থাইকবার চায় না। তাই যদি না থাকে, তাক আটকে রাখারÿক্ষমতা তো আমার নাই। আমি ছাওয়া পাওয়া ছাড়ি যাবার পারব না।’
বুধবার দাশিয়ার ছড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বোন লক্ষ্মীবালার ঘরে চলছে বিদায়ের প্রস্তুতি। ছয়টি গাছ তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সেটি কাটাকুটি চলছে। ঘরে দুটি ছাগল ছিল। একটি জেঠাসের মেয়ে আঙ্গুরিকে, আরেকটি সম্বন্ধীর মেয়ে অনন্যাকে দিয়ে দিয়েছেন। এখন কাপড়চোপড়, কাঁথাবালিশ, ঘটিবাটি আর নিজে যে রিকশা-সাইকেলের মেকারি করতেন, সেই হাতিয়ারগুলো গোছগাছ বাকি—জানালেন হরিচন্দ্র মোহন্ত। দুই ভাই হরি ও বিষ্ণুর নামে ঘরভিটেসহ ৪১ শতক জমি আছে। সেগুলোর কোনো বন্দোবস্ত হয়নি।
ভিটেবাড়ি ছেড়ে কেন যাচ্ছেন? জবাবে হরিচন্দ্রের মা লক্ষ্মীবালা বলেন, ‘এটে দুই ভাই। ওখানে (ভারত) দুই মেয়ে, ননদ, কাকারা থাকে। ইন্ডিয়া গেলে ওই দেশের সরকার দুই বছর পুইষবে, পাঁচ লাখ টাকা, থাকবার ঘর করি দিবে, তাই যাবার চাই।’
বুধবার লক্ষ্মীবালার ঘরের পেছনের গাছ দুটি যখন কাটা হচ্ছিল, ঠিক তখন কানে আসছিল ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির মঞ্চ নির্মাণের হাতুড়ির ঠুকঠাক আওয়াজ। লক্ষ্মীবালার বাড়ির কয়েক জমি পরেই বানানো হচ্ছিল উৎসব মঞ্চ। এর পাশ ঘেঁষেই সিমেন্টের পিলার পুঁতে দাশিয়ার ছড়া দাখিল মাদ্রাসার সাইনবোর্ড টানিয়ে চলছে ঘর বানানোর কাজ।
ছিটমহলের বাসিন্দারা জানান, বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তির পর দাশিয়ার ছড়ায় স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপনের হিড়িক পড়েছে। ১ হাজার ৬৪৩ একরের ছিটমহলের বিভিন্ন প্রান্তে¯ইতিমধ্যে দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ (একটি বালিকা) ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। এর কয়েকটিতে বাঁশ দিয়ে ঘরের কাঠামো খাড়া করা হয়েছে।
বুধবার বিকেলে দাশিয়ার ছড়া দাখিল মাদ্রাসার জন্য চার জমিদাতার একজন আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় নির্মাণাধীন মাদ্রাসার সামনে। তিনি বলেন, ছিটমহলের মানুষ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন শিক্ষায়। এরপর স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট ও বিদ্যুতায়নের দিকে। তিনি জানান, দাশিয়ার ছড়াকে ‘শেখ হাসিনা নগর’ নামকরণ করে ইউনিয়ন পরিষদ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সেখানকার বাসিন্দারা। এ ছাড়া একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ এবং দাশিয়ার ছড়ার মাঝের চরে ইন্দিরা-মুজিব নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখছেন ছিটমহলের লোকজন।
এত স্কুলঘর নির্মাণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ছিটমহলের বোর্ড অফিস এলাকার বাসিন্দা মফিজুর রহমান বলেন, ‘সরকার এখনো অর্ডার দেয়নি। পাবলিক আশায় আশায় ঘর তুইলবার লাইগছে। সরকার যখন বইসবে, তখন স্কুল সরকারি অইবে।’
স্থানীয় লোকজন জানান, ভুয়া ঠিকানা দিয়ে ছিটমহলের বাসিন্দারা এত দিন বাংলাদেশে পড়ালেখা করেছেন। এঁদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁদের একজন নূর ইসলাম রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে লেখাপড়া শেষ করেছেন। এখন তিনি ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে।
নূর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুয়া ঠিকানা দিয়ে আমরা লেখাপড়া করেছি, এটা সত্য। এখন সরকার যেন আমাদের অর্জিত শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি দেয়।’
কিন্তু মেরিনা ও সরোয়ার আলমদের কী হবে? ’৪৮-এর দেশভাগের মতো নাড়ির টানে দ্বিখণ্ড হওয়া মেরিনার সংসারের কী হবে?
সরোয়ারের বড় ভাই মিজানুর রহমানও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মিজান ২০১৪ সালে গঠিত দাশিয়ার ছড়ায় ইউনাইটেড কাউন্সিল নামে একটি সংগঠনের সভাপতি। এটি ছিটমহলে ভারতপন্থী বলে পরিচিত। কারণ, সংগঠনটির উদ্যোক্তা এবং সমর্থকেরা ছিটমহল বিনিময় না করে ভারতের সঙ্গে করিডোর চেয়েছিলেন। এ কারণে দাশিয়ার ছড়ায় ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির সঙ্গে ইউনাইটে কাউন্সিলের বিরোধ আছে। ইউনাইটেড সমর্থকদের কমসংখ্যকই বাংলাদেশে থাকছেন।
মিজানের সঙ্গে বুধবার সন্ধ্যায় কথা হয় ছিটমহলের কালীরহাটে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির লোকজনের বৈরিতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করিডোর চেয়েছিলাম বলে আমরা নাকি রাজাকার। তাহলে কীভাবে বাংলাদেশে থাকব?’ ভাই সরোয়ারের স্ত্রী মেরিনার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে ও চলে গেছে। এখন পলাতক।’ তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘মা-বাবা মিলেই তো বাচ্চা। মা কীভাবে একা বাচ্চাদের বাংলাদেশের বাসিন্দা করে?’
এ অবস্থায় কী করবেন, জানতে চাইলে মিজানুর বলেন, ‘ও (ভাইয়ের বউ) না গেলে থাকবে। ভাই (সরোয়ার) যাবে।’
দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, এমন প্রশ্নে সরোয়ার আলম জানান দুটি কারণ। এক, বাংলাদেশে কর্মের অভাব। দুই, এখানে আইনের শাসন নেই। যে প্রশাসন আছে তাদের টাকা দিলে কেনা যায়।
দেশ ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে না? সরোয়ারের জবাব, ‘দেশ ছেড়ে কই যাচ্ছি। জন্মগতভাবে আমরা ভারতের বাসিন্দা। যে দেশের মানুষ, সে দেশেই তো যাচ্ছি। কষ্টের মধ্যে এটাই, যে জায়গার মধ্যে নাড়ি পোঁতা, সে জায়গাটা ছেড়ে যেতে হচ্ছে আমার।’

No comments

Powered by Blogger.