মালয়েশীয় গ্রামে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের কবরের সারিঃ নাম–পরিচয় নেই আছে কেবল নম্বর by শরিফুল হাসান

বৃষ্টিতে ভেজা মাটি। সারি সারি কবর। প্রতিটি কবরের ওপর একটি করে ফলক। ফলকগুলোতে কোনো নাম-পরিচয় নেই, খোদাই করা আছে কেবল একেকটি নম্বর। মালয়েশিয়ার থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী কেদাহ রাজ্যের পকোকাসেনা জেলার কামপাং তুলাং গ্রামের রাবার বাগানের পাশে রয়েছে এসব কবর। প্রায় ৫০ বছর আগে পরিত্যক্ত এই কবরস্থানে ১০৬ জনের লাশ দাফন করা হয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। নতুন এই কবরগুলো মানব পাচারের শিকার বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের। তাদের নাম-পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। কখনো হবে কি না, সেটিও অনিশ্চিত।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে কামপাং তুলাং গ্রামের দূরত্ব ৪৩৫ কিলোমিটার। মালয়েশিয়ার ডেইলি মেইল পত্রিকার উত্তরাঞ্চলের বিশেষ প্রতিনিধি অরুলদাশকে সঙ্গে নিয়ে কয়েক দিন আগে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায় কবরগুলো, কথা হয় স্থানীয় লোকদের সঙ্গে।
গত ১ মে থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের গভীর জঙ্গলে প্রথম গণকবর আবিষ্কৃত হয়। মালয়েশিয়ায়ও এমন গণকবর থাকার অভিযোগ উঠলে কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে। তবে সাংবাদিক অরুলদাশের একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২৪ মে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ অনেক কবর পাওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর থাইল্যান্ড সীমান্ত-সংলগ্ন পারলিস রাজ্যের ওয়াংকিলিয়া থেকে ১০৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আশপাশে বড় কোনো সরকারি হাসপাতাল না থাকায় কেদাহ রাজ্যের সুলতানিয়া বাহিয়া হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর মরদেহগুলো কামপাং তুলাং গ্রামে দাফন করা হয়।
গ্রামটির রাবার বাগানের পাশের ওই কবরস্থানে গিয়ে মাটি দেখেই বোঝা গেল কবরগুলো নতুন। চারপাশে পড়ে ছিল পুলিশের ‘পুলিশ লাইন, ডোন্ট ক্রস’ লেখা প্লাস্টিকের ফিতা। নতুন কবরগুলোর ফলকে স্টিলের পাতে নম্বর দেওয়া। এই নম্বরই পরিচয় না পাওয়া মানুষগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করার সূত্র। তবে কোন মরদেহ কার—এ প্রশ্নের জবাব কখনো মিলবে কি না, সেটি জানা নেই কারও।
কবরস্থানের কাছে আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর কবরস্থানের পাশে মাঠের শেষ প্রান্তে একটি ছোট্ট নামাজঘর। সেখানে ইফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্থানীয় ৩০ থেকে ৩৫ জন। বাংলাদেশি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অরুলদাশের মাধ্যমে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। এঁদের একজন বয়সে প্রবীণ জোহারি দেশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিত্যক্ত এই কবরস্থানে সর্বশেষ ৫০ বছর আগে কারও লাশ দাফন করা হয়েছিল। পরে গাছপালা গজায়। বর্তমানে এটি ওয়াক্ফ সম্পত্তি। সপ্তাহ তিনেক আগে শুনলাম, সীমান্তের কবরগুলো থেকে উদ্ধার করা অনেক লাশ এখানে দাফন করা হবে, যারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মুসলমান। তাই গ্রামের কেউ আপত্তি করেনি। জানাজার সময় পুলিশ, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ অনেক গ্রামবাসী এসেছিল।’
এখানে কবর দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে জোহারি দেশা, মহিউদ্দিন জুশো, আবু রায়হান, আহমেদ শাহাবুদ্দিন, গালাউদ্দিন, শামসুদ্দিনসহ উপস্থিত সবাই বললেন, আশপাশে আর কোথাও এত বড় জায়গা না পাওয়ায় এখানে গাছপালা কেটে জায়গা পরিষ্কার করে কবর দেওয়া হয়। বেওয়ারিশ লাশ পেলে এখানে দাফন করা হবে।
ময়নাতদন্ত হলেও হতভাগ্য এই ১০৬ জনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি পুলিশ বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে কেদাহ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মুকরিজ তুন মাহাথির সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, নির্যাতন ও দিনের পর দিন না খেতে পেয়েই এই মানুষগুলো মারা গেছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
মৃত্যুর কারণ শুনেছেন কি না—এ প্রশ্নে ওই গ্রামের বর্ষীয়ান বাহরাম জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি, এই মানুষগুলোকে নির্যাতন করা হয়েছিল। অনেকে না খেয়ে মারা গেছে। এটা চরম বর্বরতা। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা উচিত।’ শেখ মো. জহির নামের একজন বললেন, ‘মিয়ানমার তো রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। কিন্তু বাংলাদেশের যারা আছে, তাদের পরিচয় উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কী উদ্যোগ নিচ্ছে, জানতে চাইলে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি আছে কি না, সেটি জানার সুযোগ নেই। কারণ, এদের কারও পরিচয় জানা নেই। তবে প্রত্যেকের মরদেহের ডিএনএ নমুনা হাসপাতালে রাখা হয়েছে। কোনো পরিবার যদি কখনো দাবি করে, এখানে তাদের স্বজন আছে, তবে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে। তা মরদেহের ডিএনএর সঙ্গে মিললে হয়তো পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
যেভাবে কবর আবিষ্কার: সাংবাদিক অরুলদাশ বলেন, গত মার্চে তিনি গণকবরের সন্ধানে প্রথম ওয়াংকিলিয়ায় গিয়েছিলেন, কিন্তু তখন কিছু খুঁজে পাননি। থাইল্যান্ডে গণকবর পাওয়ার পর তিনি নিশ্চিত হন, মালয়েশিয়ায়ও একই ধরনের কবর ও নির্যাতন ক্যাম্প আছে। থাইল্যান্ডের পুলিশপ্রধান ৯ মে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগও করেন। কিন্তু মালয়েশিয়া তা অস্বীকার করে। একদিন দুজন লোক তাঁর কাছে এসে পাহাড়ের ওপর গণকবর থাকার কথা জানান। তিনি তখন স্থানীয় দুজন লোকের সহায়তায় পাদংবাসার থাইল্যান্ড সীমান্তে আবার খোঁজ করেন। এরপর তিনি অনেক বন্দিশিবির আবিষ্কার করেন। পরে তিনি ধারাবাহিকভাবে এ নিয়ে প্রতিবেদন করলে মালয়েশিয়ার পুলিশ ও সেনাবাহিনী আবার অভিযান শুরু করে। ২৪ মে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কবর ও বন্দিশিবিরের কথা জানান।
ওয়াংকিলিয়া থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী মালয়েশিয়ার সর্বশেষ গ্রাম। ওয়াংকিলিয়ার যে পাহাড় দিয়ে মরদেহগুলো নামানো হয়েছে, সেটি দেখিয়ে অরুলদাশ বলেন, ‘সাগরপথে থাইল্যান্ডে আনার পর পাহাড়ের এই ক্যাম্পগুলোতে রাখা হতো মানুষদের। পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে এলেই মালয়েশিয়া। যারা মুক্তিপণ দিত, তাদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেওয়া হতো। কেউ কেউ অবশ্য এই নির্যাতন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়া সীমান্তে চলে আসতে পেরেছে।’
ওয়াংকিলিয়া পাহাড়ি ছোট্ট গ্রাম। ২৫০ জনেরও কম মানুষের বসবাস। ওয়াংকিলিয়ার পাহাড়ের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা মানুষ প্রায় সময়ই গ্রামের মসজিদে আশ্রয় নিত বলে জানান গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আদনান ও জুনায়েদ। আদনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই-আড়াই বছর ধরে আমরা এই দৃশ্য দেখছি। পালিয়ে আসা লোকজনের শরীরে থাকে আঘাতের চিহ্ন। আমরা তাদের চিকিৎসা দিতাম, খাবার দিতাম। গত ঈদের দিন আমরা পাঁচজন বাংলাদেশিকে পেয়েছিলাম।’
ওয়াংকিলিয়া গ্রাম থেকে কামপাং তুলাং গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। অরুলদাশ প্রতিবেদন না করলে হয়তো এসব কবর আবিষ্কৃত হতো না। কামপাং তুলাং গ্রামে দাফন হওয়া এসব মানুষের স্বজনেরা হয়তো এখনো জানে না, তারা পরিচয়হীন হয়ে এখানে আছে। আর কবরগুলো সাক্ষী হয়ে আছে একবিংশ শতাব্দীর দাসপ্রথা ও চরম বর্বরতার।
সারি সারি কবর ১০৬টি। কবরগুলো মানব পাচারের শিকার বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের। নাম–পরিচয় না জানা এই ১০৬ জনের কবর রয়েছে মালয়েশিয়ার থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী কামপাং তুলাং গ্রামে। সীমান্তবর্তী ওয়া​ংকিলিয়া থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল l ছবি: প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.