অপরাধ ও মামলা বেড়েছে, কেবল বাড়েনি বিচারক -চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি by গাজী ফিরোজ

জনসংখ্যা ও অপরাধ বিবেচনায় চট্টগ্রাম মহানগরে গত ১৫ বছরে দুই দফায় ১০টি নতুন থানা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের পরিসংখ্যান বলেছে, থানা বাড়লেও অপরাধ কমেনি। অপরাধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মামলার সংখ্যাও। কিন্তু মামলাজট কমাতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে (মহানগর হাকিম আদালত) বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। এতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বেড়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বর্তমানে ২৪ হাজার ৯৬১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর সঙ্গে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০টি নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। চট্টগ্রামে দুটি অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম এবং চারটি মহানগর হাকিমের নতুন পদ সৃষ্টির জন্য ২০১৩ সালে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো না হলে বিচারাধীন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে নয় বছর পর্যন্ত সময় লাগবে বলে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে একজন মুখ্য মহানগর হাকিম, একজন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম এবং ছয়জন মহানগর হাকিম নিয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি আদালত পরিচালিত হচ্ছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনটি দ্রুত বিচার আদালত ও একটি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতেরও দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বিচারকদের। এর মধ্যে মুখ্য মহানগর হাকিম পদটি বদলিজনিত কারণে গত ২২ জুন থেকে শূন্য রয়েছে।
চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আবিদ হোসেন প্রথম আলোকে জানান, ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজের মাধ্যমে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের দুটি ও মহানগর হাকিমের চারটি পদ বাড়ানোর জন্য তৎকালীন মুখ্য মহানগর হাকিম আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠান। কিন্তু প্রস্তাবটি এখনো ঝুলে আছে। তিনি বলেন, বিচারাধীন মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মহানগর হাকিমের পদ বাড়ানো দরকার। ২০০৭ সালের তুলনায় বর্তমানে দেড় গুণ মামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১০০ মামলা হচ্ছে। কিন্তু বিচারকের সংখ্যা না বাড়ায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমছে না।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অপরাধ শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম নগরে খুনের ঘটনা ঘটে ৯২টি, ধর্ষণ ৫৮টি ও অপহরণ ১৭টি। পরের বছর তা আরও বেড়ে যায়। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী খুন ১১৮টি, ধর্ষণ ৭৫টি ও অপহরণের ৫৩টি ঘটনা ঘটেছে। অপরাধ বাড়তে থাকায় চট্টগ্রামের থানার সংখ্যা ছয় থেকে বাড়িয়ে ২০০০ সালে ১২টিতে উন্নীত করা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে আরও চারটি নতুন থানা চালু করা হয়।
নতুন করে আরও দুই থেকে তিনটি থানা স্থাপনের বিষয়ে কাজ চলছে বলে জানান চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম শহিদুর রহমান। তিনি বলেন, নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অপরাধের ধরন ও অপরাধ বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও থানা দরকার।
নগরে অপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গে মামলার সংখ্যাও বেড়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আবিদ হোসেন। তিনি জানান, ২০১৩ সালে মামলা হয়েছে ২১ হাজার ৭৯৭টি। ২০১৪ সালে ২৫ হাজার ৪৭৫টি। গত ছয় মাসে (জুন পর্যন্ত) দায়ের হয়েছে ১১ হাজার ৪৯৫টি মামলা।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি উল্লেখ করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে একজন মুখ্য মহানগর হাকিম ও তিনজন মহানগর হাকিম নিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় নগরে থানার সংখ্যা ছিল ছয়টি। জনসংখ্যা ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ায় বর্তমানে নগরে থানার সংখ্যা ১৬টি। ১৯৯২ সালে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৮ হাজার ৫৬৭টি। মামলা বাড়ার কারণে ওই বছর মহানগর হাকিমের সংখ্যা বৃদ্ধি করে পাঁচে উন্নীত করা হয়। মামলার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের একটি পদ বাড়ানো হয় ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সরকারি কৌঁসুলি জানান, ২০০৭ সালে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হাজার ১০৬টি হওয়ায় পরের বছর আরেকটি মহানগর নগর হাকিমের পদ বাড়ানো হয়। ২০০৭ সালের তুলনায় বর্তমানে মামলার সংখ্যা দেড় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন মহানগর হাকিমের পক্ষে মাসে গড়ে ৩০টির বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। সে হিসেবে বর্তমানে বিচারাধীন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে নয় বছর সময় লাগতে পারে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক জানান, থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর আসামিদের হাজিরা, রিমান্ড শুনানি, তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ, নারাজি আবেদন শুনানি, মহানগর হাকিম আদালতের এখতিয়ারাধীন মামলাগুলোর নিষ্পত্তি, ভুক্তভোগী ও আসামির জবানবন্দি গ্রহণসহ অনেক কাজ করতে হয় মহানগর হাকিমদের। ফলে বিচারাধীন মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে। আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। বিষয়টি আইনমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.