আবদুল হাই বাচ্চুকে বাদ দিয়ে প্রতিবেদন! by মোর্শেদ নোমান

বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে দায়মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান পর্যায়েই সাবেক এই চেয়ারম্যানের কোনো দায় খুঁজে পায়নি দুদকের অনুসন্ধান দল। তারা সমস্ত দোষ ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর চাপিয়ে অনুসন্ধান শেষ করেছে।
দুদকের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, শিগগিরই অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদনে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে বাদ দিয়ে সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ ঋণ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা ও ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে অন্তত ৫০টি মামলা করার সুপারিশ রয়েছে।
এর আগে ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সম্পদ ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে দুদক। এঁদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মূল জালিয়াতির ঘটনায়ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ থাকছে বলে জানা গেছে।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে অর্থ আত্মসাতের জন্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর দায়ের কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ব্যাংকটিতে ‘হরিলুটের’ পেছনে আবদুল হাই বাচ্চু জড়িত বলে একাধিকবার উল্লেখ করেন। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংক-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনগুলো দুদককে অনেক আগেই হস্তান্তর করা হয়। জাতীয় পার্টির নেতা হলেও উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের কারণেই আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আরও বিতর্কিত হবে। ‘কান টানলে মাথা না এলে’ জনগণের কাছে তার যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে হবে। দুদকের অবস্থান রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত কি না, তা জনগণ জানতে চাইবে। তবে দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তাঁর সুপারিশ কমিশনের কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দেবেন। সে ক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ বাদ পড়ে গেলেও তদন্ত পর্যায়ে তাঁকে মামলার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া অন্য পর্যায়েও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তখনো তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেই ৮ থেকে ১০ জনের একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতে মূল ভূমিকা রেখেছে। সূত্রটি আরও জানায়, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্য ব্যাংক থেকে নিজেদের পছন্দের কয়েকজনকে ব্যাংকের গুলশান, শান্তিনগর ও প্রধান শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়। আর এসব কর্মকর্তার মাধ্যমেই বড় বড় ঋণ প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে নথিপত্রের ক্ষেত্রে খুব সচেতনভাবেই সই করা থেকে বিরত থাকতেন পর্ষদ সদস্যরা। অনেকগুলো ঋণ প্রস্তাবে কাগজে কলমে বোর্ড চেয়ারম্যান সই না করলেও মৌখিক নির্দেশে ঋণ দিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান।
তবে বেসিক ব্যাংক সূত্র জানায়, অন্তত ৩৫টি বড় ঋণ দেওয়ার ঘটনায় ব্যাংকের কোনো শাখা বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তর থেকে কোনো ধরনের প্রস্তাব বোর্ডের কাছে উত্থাপন করা হয়নি। শুধু বোর্ড সভার কার্যবিবরণী দিয়েই ঋণ অনুমোদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ বোর্ড সদস্যদের বিরুদ্ধে নথিগত প্রমাণ না পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
এমনিতেই দীর্ঘদিন ‘কার্যত’ বন্ধ থাকার পর এ মাসেই বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানে সক্রিয় হয় দুদক। গত মাসে জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে বেসিক ব্যাংক নিয়ে আলোচনা এবং ৭ জুলাই সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের পর থেকে দুদক অনেকটাই নড়েচড়ে বসে। অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় অনুসন্ধান দলকে। এরপরও সাবেক চেয়ারম্যানের কোনো দায় পায়নি অনুসন্ধান দল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মার্চে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ওই চার বছর তিন মাসে ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হলে শুরুতে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা চিহ্নিত হলে সরকার ব্যাংক পুনর্গঠনে বাধ্য হয়। প্রথমে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। গত বছরের ২৯ মে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় ৪ জুলাই অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে পদত্যাগপত্র দেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু।
পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের ছয়জন কর্মকর্তাকে সাময়িক এবং সাতজনকে স্থায়ীভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তাঁদের মধ্যে সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মোনায়েম খান ও মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এই দুজনের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়। এ ছাড়া বরখাস্ত হওয়া আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান করছে দুদক।
তবে লুটপাটের মূল হোতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি এখন দেশের বাইরে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.