৫০ বছর ধরে চলছে বর্জ্য শোধন ছাড়াই হাজারীবাগের এই ট্যানারিশিল্প by পার্থ শঙ্কর সাহা

ট্যানারি বর্জ্যের স্তূপের কারণে রাজধানীর হাজারীবাগের
এই সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে -প্রথম আলো
রাজধানীর হাজারীবাগে ১৯২টি ট্যানারির কোনোটিরই বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বর্জ্যের শোধন ছাড়াই চলছে চামড়াশিল্পের এসব কারখানা। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অপরিশোধিত বর্জ্য এই শিল্পের শ্রমিক, আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বুড়িগঙ্গা নদীদূষণের প্রধান কারণও নদীসংলগ্ন হাজারীবাগের এই ট্যানারিশিল্প।
সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর, ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং একাধিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ট্যানারি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলা হয়। এ ছাড়া প্রতিদিন কঠিন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে আনুমানিক ১০০ টন। অবশ্য পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সাম্প্রতিক এক জরিপে জানিয়েছে, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময় প্রতিদিন কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০০ মেট্রিক টন। পবার দাবি, এতে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে।
হাজারীবাগ ট্যানারিশিল্প এলাকার কারখানা থেকে রাস্তাঘাট, পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা, আশপাশের বস্তি—সবকিছুই ট্যানারির বর্জ্যে ভরা। বিশেজ্ঞদের মতে, পুরো এলাকাই বসবাস এবং কাজের জন্য অনিরাপদ। এরপরও হাজারীবাগে ট্যানারিশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ কাজ করছে।
হাজারীবাগের ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, এর মধ্যে আছে ক্রোমিয়াম, সিসা, সালফিউরিক অ্যাসিড, হাইড্রোজেন সালফাইট, ফরমিক অ্যাসিড, রং, তেল। এসব দ্রব্যমিশ্রিত তরল বর্জ্য সরাসরি চলে যায় নদীতে। অনেক ভারী ধাতু, চুন, পশুর মাংস, হাড়, দ্রবীভূত চুল, চর্বি, লবণ ইত্যাদি বর্জ্যও পড়ে থাকে যত্রতত্র। এসব বিষাক্ত ও বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য পানি, বায়ু, মাটিদূষণসহ জনস্বার্থের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অমলকান্তি দেব বলেন, তিনটি ধাপে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এর মধ্যে প্রথম ধাপে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পর তাতে ব্যাপক পরিমাণে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এরপর দুই ধাপেও রাসায়নিকের ব্যবহার রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ক্রোমিয়াম, হাইড্রোজেন সালফাইটসহ রাসায়নিক উপাদানগুলো অপরিশোধিতভাবে প্রকৃতিতে মিশলে তা পরিবেশে ও মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৩ সালে একবারই কেবল এক অভিযানে তিনটি ট্যানারিকে ৬৮ লাখ টাকা জরিমানা করে। ওই বছর বে ট্যানারিকে ৪০ লাখ, আইয়ুব ট্যানারিকে ২০ লাখ এবং ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিনকে আট লাখ টাকা জরিমানা করে। এরপর আর কোনো অভিযান করতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. আলমগীর গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই অভিযানের পরই রাজনৈতিক মহল ও মালিকদের কাছে থেকে প্রবল চাপ আসে। ফলে অভিযান পরিচালনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। এ ছাড়া, যেহেতু এসব ট্যানারি এখন স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় আছে, তাই আমরাও অভিযান বন্ধ করে দিয়েছি।’

No comments

Powered by Blogger.