অনাবৃতা by উম্মে মুসলিমা

একটা টেলিফোন কল। রুবিতার রক্ত ঠান্ডা হয়ে আসে।
আজ শুক্রবারের সকালেই একটা দৈনিকের সাময়িকীতে ওর একটা কবিতা এসেছে। কবিতাটা ও পাঠিয়েছিল মাস কয়েক আগে। প্রথম তিন সপ্তাহ যখন প্রকাশিত হলো না, তখন ভেবেই নিয়েছিল, ওটা আর বেরোবে না। ভাবছিল, এ সপ্তাহেই অন্য একটা দৈনিকে পাঠিয়ে দেবে। পত্রিকা হাতে পেয়েই আগে সাময়িকীর পাতাটা বের করে নিয়েছিল, তবে কবিতাটি দেখেনি। হতাশ হতে হতে সে ভুলেই গেছে যে আজ শুক্রবার। বর টুরে যাবে। তার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিল। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে আবৃত্তি, ‘অতল অতল বলে কাঁদে মন অগভীরে বাস/ রোমশ বুকের বন, হিরে খুঁজে বেতফল পাস’।
রুবিতা ঝটিতে হাতের কাপড় মেঝের ওপর ছুড়ে ফেলে নাফিসের হাত থেকে পাতাটা কেড়ে নেয়। ‘এসেছে এত দিনে!’ হ্যাঁ, রুবিতার প্রকাশিত কবিতা থেকেই নাফিস মানে ওর বর আবৃত্তি করছিল।
‘কে সেই হতভাগা অগভীর? এ বুকেও তো জঙ্গল’—বলে নিজের রোমশ বুকে হাত বোলায় নাফিস।
‘তোমার এই এক স্বভাব। এ জন্যই তো তোমাকে কবিতা দেখাই না।’
‘কবিতা তো আর আসমান থেকে নাজিল হয় না। এ মাটির মানুষ আর প্রকৃতি বাদ দিয়ে তুমি কত দূর যাবে?’
‘কবিতা বুঝলে আর এ কথা বলতে না। মানুষ উপলক্ষ, বেদনা-ই বিধেয়।’
‘ওরেব্বাস! মহাকবি কালিদাস। এবার আমার ব্যাগটা দয়া করে গুছিয়ে দাও। দেখো, গতবারের মতো যেন আন্ডারওয়্যার না দিয়েই পাঠিয়ে দিয়ো না। কবিকে নিয়ে ঘরসংসার! বহুত ঝামেলায় আছি।’
‘বেশ তো, টুরে টুরেই কাটিয়ে দাও। ঝামেলায় জড়ানোর দরকার কী?’
‘এ যে আমার মধুর ঝামেলা’—রুবিতাকে বুকে শক্ত করে চেপে ধরে নাফিস। রুবিতা নাফিসের রোমশ বুকে নাক ঘষে।
নাফিস চলে গেলে বিছানায় উপুড় হয়ে পত্রিকা খোলে রুবিতা। এ সময়টা একান্তই ওর। ছেলে স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল। দুপুরটা পুরোপুরিই ওর। সত্যি বলতে কি, নাফিস টুরে গেলে ওর ভালোই লাগে। একা থাকার মজাই আলাদা। পুরো বিছানাটাই ওর। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেমন-তেমন করে যখন ইচ্ছে শোয়া যায়। ইচ্ছে না হলেও স্বামীকে শরীর বিছিয়ে দেওয়ার ভান করতে হয় না। কিন্তু সে-ও তো বড়জোর তিন দিন। চার দিনের দিন নাফিসের গন্ধ না পেলে ওর অসহ্য লাগে সবকিছু। যদিও নাফিস একটু সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত কিন্তু সেটাও ইতিবাচক হিসেবেই মেনে নিয়েছে রুবিতা। আরে বাবা, ভালোবাসে বলেই তো সন্দেহ করে। বিয়ের প্রথম প্রথম অবশ্য ওর খুব কষ্ট হতো। একা একা শপিংয়ে যেতে দিত না, বাসার বারান্দায় দাঁড়াতে নিষেধ করত, এমনকি ফোনেও আড়ি পাতত। যখনই ভালোবাসায় নিবিড় হতো তখনই ওই এক প্রশ্ন, ‘সত্যি করে বলো তো কজনকে ভালোবাসতে?’ এ ষোলো-সতের বছরে স্বাভাবিক নিয়মেই ওসব কমে এসেছে। তবু রুবিতার কবিতার ‘তুমি’টা কে, তা জিজ্ঞাসা করতে এখনো কম যায় না। খোঁচা দেয় কিন্তু মনে মনে ভেবে পুলকিত হয় যে বউ তার প্রতিই বিশ্বস্ত। রুবিতাও নাফিসের এসব ছোটখাটো দোষত্রুটি এক পাল্লায় আর ভালো গুণগুলো আরেক পাল্লায় রেখে মাপজোক করে দেখেছে যে গুণের পাল্লাই বেশি ভারী। ওরকম সৎ আর কর্মঠ অফিসার আজকাল খুবই দুর্লভ।
ছেলেটা পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। সামনেই ওর এসএসসি পরীক্ষা। নিজের ঘর বন্ধ করে রাখে। প্রায়ই রুবিতার ইচ্ছে করে ছেলের সঙ্গে একটু আড্ডা দিতে। দরজা নক করে সে—‘কী করছ আব্বু?’
‘কী আবার? পড়ছি।’
‘খোলো একটু।’
‘কী, হাবি নেই তাই মন খারাপ?’—বলে দরজা খোলে অরূপ।
ছেলের দূর্বাঘাসের মতো কেবল গজিয়ে ওঠা নরম গোঁফে আঙুল ছুঁয়ে ওর বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ে সে।
‘তা একটু খারাপ বৈকি। তুই-ও তো সময় দিস না।’
‘সময় দিলে হাবির মতো ব্রিলিয়ান্ট চাকুরে হতে পারব? সিভিল সার্ভিসে বাবার রেজাল্ট ভালো ছিল বলে কেমন সবার আগে আগে প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছে। তুমি বড় চাকুরের বউ। তোমার তো রমরমা!’
‘বারে, আমার বুঝি নিজের কোনো পরিচয় নেই?’
‘ওহো, তুমি তো আবার কবি রুবিতা হোসেন। দেশের প্রথম সারির কবি। এ সপ্তাহে এসছে নাকি একটা?’
‘তুই-ও তো লিখতিস। আর লিখিস না কেন?’
‘এবার কেটে পড়ো তো কবি। আমার মেলা পড়া আছে। বসে বসে কবিতা লেখো গে, যাও’—বলে মায়ের কপালে চুমো খেয়ে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে মাকে বের করে দেয় অরূপ।
যেদিন রুবিতার কবিতা আসে পত্রিকায়, সেদিন ওর সব গুমোট কেটে যায়। আকাশ সেদিন মেঘলা হলে ঝিরিঝিরি মেঘকণায় ভিজতে ইচ্ছে হয় ওর। একবার এক রাতে নীলগিরিতে ও মেঘ মেখেছিল। মেঘে ভেজা আর বৃষ্টিতে ভেজা কত আলাদা! মেঘ তো বৃষ্টিরই রেণু। অথচ একটুও গা ভেজে না। মুখে হাত ঘষলে মনে হয় যেন বৃষ্টির ছাট লাগা বন্ধ কাচের জানালার ভেতরের ভিজে ভাব। আর্দ্র আর কোমল। আবার যেদিন সকালে তেজি রোদ, সেদিনও ওর চোখধাঁধানো ঝিলিক নেচে যায় সাদা করগেট টিনের চালে। মুহূর্তে ও ফিরে যায় ওদের গ্রামের বাড়ি। ঘরের দেয়ালের তেকোনা ছায়ায় ঘাসের পাটিতে বসে থাকে আঁটো বিনুনির কিশোরী। কারণ, কৈশোর আর যৌবনের শুরুর কাল ছাড়া ওর কবিতার কাল বয়সী হতে জানে না। রুবিতা বারবার—দশবার পড়ল নিজের কবিতা। কবিতাটা আসলেই ভালো হয়েছে। ওর কবিতার ওপরেই দেশের স্বনামধন্য আরও দুজন পুরুষ কবির কবিতা। ওঁদের কবিতাও একবার করে পড়ল। ভাবল, তাঁরা নিশ্চয় ভাবছেন, কে এই রুবিতা হোসেন? এত পরিপক্ব হাত মেয়েটির? কেউ না কেউ নিশ্চয় টেলিফোন করবে। এর আগেও কবিতা এলে দু-চারটে ফোন সে পেয়েছে। প্রশংসা শুনতে ভালোই তো লাগে। ভাবতে ভাবতেই একটা ফোনকল। সারা শরীর হিম হয়ে আসে রুবিতার।
২. ছাত্রজীবনে ভালো ছাত্রী হিসেবে পরিচিতি ছিল রুবিতার। আসল নাম ছিল মোছাম্মৎ রাবেয়া খাতুন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় খুব ডাটিশ এক মেয়ে এসে ভর্তি হলো ওদের মফস্বলের স্কুলে—রুমকি রহমান। বাবার নাম জামিল রহমান। তখন গ্রামের মেয়েদের নামের শেষে বেগম, খানম বা খাতুন আর শুরুতে মোছাম্মৎ। রুমকির খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠল রাবেয়া। রুমকি গড়পড়তা ছাত্রী। ওর চুলের স্টাইল, স্কুলের ব্যাগ, ছাতা—সবই চমক লাগানো। রাবেয়া দেখতে ভালো, ছাত্রী ভালো কিন্তু কিছুতেই রুমকির মতো দেখায় না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফরমফিলাপের সময় রুমকি পরামর্শ দিল, ‘শোন রাবেয়া, তোর নাম পাল্টে দে। নাম দে রুবিতা হোসেন। বড্ড সেকেলে নাম তোর।’
‘কিন্তু আব্বা জানলে যে আস্ত রাখবে না।’
‘দিয়ে দে, একবার হয়ে গেলে রাগ করে কোনো লাভ হবে না।’
‘কিন্তু আমার আব্বার নাম তো আইনউদ্দিন, হোসেন কেন?’
‘শোন, আমিও ভেবেছি। রুবিতা আইন বা রুবিতা উদ্দিন ঠিক মিলছে না। হোসেনটা ভালো যায়।’
‘কিন্তু...’
কোনো কিন্তুই ধোপে টিকল না। রুমকির জবরদস্তিতে মোছাম্মৎ রাবেয়া খাতুন হয়ে গেল রুবিতা হোসেন। ম্যাট্রিকের প্রবেশপত্র হাতে নিয়ে ওর আব্বা তো থ। রুবিতা বাথরুমে গোসল করতে ঢুকে আর বেরোতে পারছিল না। বাইরে ওর আব্বার চিল্লাপাল্লা।
‘আমার মায়ের নামে ওর নাম রেখেছিল আমার বাপজান। আমার মৃত পিতাকে অপমান করার সাহস ওকে কে দিল?’
মা গাঁইগুঁই করে মেয়েকে বাঁচানোর জন্য যা বলছিল, বাথরুম থেকে সবই শুনল রুবিতা—‘আজকালকার মেয়েদের নাম অমন পুরোনো ধাঁচের হলে চলে? আমার তো বেশ লাগছে।’
‘এই তোমার আস্কারা পেয়ে পেয়েই মেয়েটা বখে যাবে, আমি বলে রাখলাম। আবার পদ্য লেখে! মেয়েদের এত বাড়াবাড়ি ভালো না।’
যেদিন ম্যাট্রিকের রেজাল্টে রুবিতা হোসেন প্রথম বিভাগ পেল, কেবল সেদিনই ওর আব্বার রাগ পড়ল। তিনি খুশি হয়ে মেয়েকে রুবিতা বলে ডাকলেন। কাছে বসিয়ে পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়া রেশমের মতো লম্বা চুলে কয়েকবার হাত বোলালেন। বিকেলে স্থানীয় সাহিত্য পত্রিকা চর্যার হরিণী থেকে শুভেচ্ছাসহ এক তোড়া ফুল এল। রুবিতা লুকিয়ে সে ফুল বুকে রাখল। কারণ, সে ফুলে যে তার প্রেমাস্পদের ছোঁয়া লাগানো! পত্রিকার সম্পাদক জুনায়েদ কবির তার প্রাণের কবি। কিশোরীর প্রথম প্রেম। ইতিমধ্যে ওর দুটো কবিতা ছেপেছে চর্যা। ওদের মফস্বল শহরের গণগ্রন্থাগারে তিনবার দেখা হয়েছে সম্পাদকের সঙ্গে। প্রথমবার কেবল কবিতার কথা। কীভাবে অন্ত্যমিল না রেখেও ছন্দ রাখতে হবে, কবিতার বিষয়বস্তু কী হবে, চিত্রকল্পের ব্যবহার কীভাবে আনতে হবে কবিতায় ইত্যাদি। রুবিতা মানুষটিকে দেখছিল। লম্বা, একহারা, মুখে লেপ্টে থাকা পাতলা দাড়ি। গোঁফ কিন্তু ঘন ও ঠোঁটছোঁয়া। পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করে খানিকটা গুটানো। বয়স ত্রিশের কম তো নয়ই। কী কণ্ঠস্বর! একবার শুধু রুবিতার কড়ে আঙুলে একটুকু ছোঁয়া। ওর পদনখ থেকে কেশাগ্র পর্যন্ত সেকি ঝড়!
রুবিতা বাড়ি ফিরে ঘুমুতে পারে না। এঘর-ওঘর, কুয়োতলা, খিড়কি দরজা, পেছনের বারান্দার শেওলাজমা সিঁড়িতে গিয়ে বসে। একটুও খেতে ইচ্ছে করে না। এই অস্থিরতার মানে কী? এটা কোন অসুখ? মা ভাবছিল, মেয়েটার হঠাৎ কী হলো! রুমকির সঙ্গে দেখা করল একদিন বিকেলে। দু-এক দিনের মধ্যেই রুমকিরা চলে যাবে ঢাকায়। গোজগাছ চলছে। রুমকি স্ট্রেটকাট রুবিতাকে বলল, ‘তুই প্রেমে পড়েছিস।’
‘ধ্যাৎ, ওরকম বয়স্ক লোক।’
‘আমার মাথা ছুঁয়ে বল তো, ওকে দেখার জন্য তোর জান ছটফট করে না?’
‘আমি জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না’—রুবিতা কেঁদে ফেলল।
‘শোন, প্রথম প্রেম তো তাই অমন লাগছে। মফস্বলে প্রেম করার অনেক ঝক্কি। চিঠি লিখবি কিন্তু সাবধান—ধরা পড়া যাবে না। যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তো আরও কেলেঙ্কারি। বিবাহিত লোকরা কিন্তু খুব শয়তান। বেশি কাছে ভিড়তে দিবি না।’
‘তুই এত সব জানলি কীভাবে? ’
‘আমার বড় আপু। ও বলে দিয়েছে, দুলাভাইদের সঙ্গে বেশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করবি না। ওরা শুধু সুযোগ খোঁজে।’
চিঠিতে মন ভরছিল না কারুরই। গ্রন্থাগারে আবার দেখা। একটু ছুঁতে মন চায়। সুযোগ বুঝে একে অন্যের হাত ধরে। রুবিতার হাতের তালু ঘেমে নেয়ে ওঠে। সারা শরীর কাঁপতে থাকে। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। গ্রন্থাগার খানিক ফাঁকা হতেই আলমারির আড়ালে দাঁড়িয়ে রুবিতাকে বুকে টেনে নেয় জুনায়েদ। গভীর চুম্বনে ওর অনাঘ্রাতা পুষ্পের কোমল পাপড়ি-ঠোঁট দংশনে দলিত করে এক লহমায়। রুবিতা ভীরু হরিণীর মতো বুকে বই চেপে পালিয়ে যায়।
জুনায়েদ কবির বিবাহিত। একটা বছর চার-পাঁচের ছেলেও আছে। রুবিতা যে জানে না তা নয়। কিন্তু জুনায়েদের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ওকে ‘ন্যায়-অন্যায় জানিনে জানিনে জানিনে শুধু তোমারে জানি’ বলে প্রতিনিয়ত তুমুল আন্দোলিত করত। জুনায়েদ লিখেওছিল, ‘প্রিয়তমা আমার, তোমার জন্যে আমার প্রথা ভাঙতে ইচ্ছে করে। গদ্যে বসবাস করতে করতে আমার জীবন ঊষর মরু। কবিতার ঝরনাতলায় অবিরল ভিজতে চাই। তুমি কি নিয়মভাঙা ঝরনা হতে পারো না?’
নিয়ম ভাঙতে পারেনি রুবিতা। সে কি আর সম্ভব ছিল? ভালো কলেজে পড়ার ইচ্ছা, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন, মর্যাদাপূর্ণ চাকরি রুবিতাকে কাব্যকলার অধিক টানত। তা ছাড়া একজন বিবাহিত সংসারী মানুষকে সংসারবিচ্ছিন্ন করে এলাকায় মুখরোচক খবর জন্ম দেওয়ার সাহসও ওর ছিল না। একদিন জুনায়েদের পাঠানো সব চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ঠোঁটে প্রথম প্রেমের অমোচনীয় স্পর্শ সঙ্গে নিয়েই চলে গিয়েছিল দূরে। তারপর পড়াশোনা, বিয়ে। চাকরি করারও ইচ্ছে ছিল ওর। নাফিস তেমন গা করেনি। তবে কবিতা ছাড়েনি রুবিতা। বিয়ের পরপর ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা পাঠাত। অনেক দিন কেউ ছাপেনি। মাত্র পাঁচ-ছয় বছর হলো ওর কবিতা বেরোচ্ছে। ইতিমধ্যে নাফিসের উদ্যোগে দুটো বইও বের হয়েছে। ইদানীং পত্রিকাআলারা যখন ওর কাছে ফোন করে কবিতার জন্য অনুরোধ করে, তখন নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ মনে হয় রুবিতার।
৩. টিভিতে একটা প্রিয় সিনেমা দেখতে দেখতে যান্ত্রিক গোলযোগে যেমন হঠাৎ ছবি স্থির হয়ে যায়, তেমনি ফোনকলটার পর নিজের কবিতার প্রথম লাইনের ওপর রুবিতার চোখ স্থির হয়ে যায়।
‘হ্যালো’।
‘হ্যালো, কে?’—রুবিতা ভেবেছিল নিশ্চয় বন্ধুরা কেউ তার কবিতাটা পড়েই উচ্ছ্বসিত।
‘রাবেয়া? আমি জুনায়েদ কবির।’
সেই মুগ্ধ করা কণ্ঠস্বর। কবে যেন রুবিতা কোনো এক পত্রিকায় পড়েছিল, এলিজাবেথ টেইলর তার প্রেমিক ও স্বামী রিচার্ড বার্টন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিল, ‘কেবল তার কণ্ঠস্বরই আমাকে যৌন উত্তেজনার শীর্ষে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ প্রায় পঁচিশ বছর পর সেই কণ্ঠস্বর! রুবিতার নিজের বুকের শব্দ কানে এসে লাগছে। কিন্তু রাবেয়া নাম জানলেও জুনায়েদ তো ওকে সব সময় রুবিতা নামেই ডেকেছে। আজ আবার রাবেয়া কেন? রাগ হচ্ছিল ওর।
‘কী খবর? কেমন আছেন?’
‘এই তো। তোমার কবিতা পড়লাম।’
‘হুম। ফোন নম্বর পেলেন কোথায়?’
‘ওই পত্রিকা অফিস থেকে। ভালো হয়েছে কবিতাটা।’
‘আপনি আর লেখেন না তো।’
‘কবিদের বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রেরণা চাই।’
‘তাই’,—বলে কিছুক্ষণ দু-প্রান্তই চুপচাপ। রুবিতা চাচ্ছিল দ্রুত কথা শেষ হোক।
‘তোমার সব খবরই রাখি। তুমি ভালো আছ জেনে ভালো লাগে। আমারও তো একটু ভালো থাকতে ইচ্ছে করে।’
‘থাকুন না।’
‘থাকাটা এ মুহূর্তে অনেকটাই তোমার ওপর।’
‘কীভাবে?’—রুবিতার হাতের তালু পায়ের তালু ঘেমে একাকার। প্রথম দিনের ঘাম নয়, এ ঘাম যেন কালঘাম। ‘তোমার স্বামী বড় চাকুরে। ওদের মন্ত্রণালয় থেকে একটা চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। আমার ছেলে আবেদন করেছে। এবারই ওর চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। তেমন মেধাবী নয়। এত দিনে কিছুই করতে পারেনি। তোমার স্বামীকে বলে যেভাবেই হোক আমার ছেলের চাকরিটা পাইয়ে দিতে হবে।’
‘কিন্তু ও তো একটু অন্য টাইপের। ওকে এ সব বলা যায় না। যোগ্যতা থাকলে নিশ্চয় হবে।’
‘আমলারা কী টাইপের হয়, তা সবাই জানে। কাজটা তুমি করে দেবে।’—জুনায়েদের কণ্ঠে আদেশের সুর।
‘কিন্তু...’—রুবিতা আবারও নাফিসের সৎ গুণ নিয়ে বলার চেষ্টা করে।
‘তুমি ছিঁড়ে ফেললেও আমি কিন্তু তোমার সব চিঠিই রেখে দিয়েছি।’—খানিক বাদে জুনায়েদ বলে, ‘পরে আবার ফোন করব।’ ফোন লাইনটি কেটে দেয় এরপর।
বাইরে অনেক বাতাস। যেদিন পত্রিকায় রুবিতার কবিতা আসে, সেদিন ওর প্রকৃতি হয়ে ওঠে সদ্য নেয়ে ওঠা নতুন ষোড়শী। ঝলমলে, টানটান আর ভীরু ভীরু। যেন ওর নিজের যৌবনেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ জোর বাতাসের এই সকালে ও যেন অশুভ সাইক্লোনের পদধ্বনি শুনতে পেল। দমকা বাতাসে ওর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হাতের মুঠো থেকে অনায়াসে উড়ে গেল সাময়িকীর পাতাটা।
রুবিতার বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিয়ে ওকে প্রায় অনাবৃত করে দিচ্ছে বাতাস।

No comments

Powered by Blogger.