মানব পাচারকারী কোটিপতি জামাল by আশরাফুল ইসলাম

ভাগ্যান্বেষণে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েই যেন হাতে আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যায় জামাল। ধূর্ত ও উচ্চাভিলাষী জামাল নেমে পড়ে মানব পাচারে। নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। এই ধান্ধায় হাতে আসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। বদলে যায় গ্রামের বাড়ির চেহারাও। টিনের ঘর ভেঙে কোটি টাকা খরচ করে বাড়িতে ওঠে তিন-তিনটে বিশাল হাফ বিল্ডিং। বাড়ির মতো বাড়ে হাওরের জমিও। প্রায় ৪শ’ একর জমি থেকে বছরে গোলায় ওঠে প্রায় ৩০ হাজার মণ ধান। জামালের দেশে ফেরা মানে এলাকায় হইচই পড়ে যাওয়া। গলায় দেড়-দুই ভরি ওজনের সোনার চেইন, আঙুলে জোড়া আংটি, হাতে ব্রেসলেট আর ফ্যাশনেবল জামা-কাপড়ের সঙ্গে চুলের কাটিং। বাজারে-বাড়িতে বিশাল আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া। মাত্র ৪ বছরে এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক হাওরের প্রত্যন্ত গ্রাম আবদুল্লাহপুর উত্তরপাড়ার যুবক জামাল। মানব পাচারের মাধ্যমে কোটিপতি বনে যাওয়া মালয়েশিয়াপ্রবাসী জামাল মিয়া (৩২) সম্প্রতি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। অষ্টগ্রাম উপজেলার আবদুল্লাহপুর বাজার থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত এই মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তারের পর তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে চক্রের অন্য সদস্যদের ধরতে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অভিযান পরিচালনাও করে পুলিশ। তবে জামাল গ্রেপ্তারের দুই সপ্তাহ পরও পুলিশ আর কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। উল্টো আইনের ফাঁক গলে সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসে গ্রেপ্তার হওয়া জামাল মিয়া। এলাকাবাসী জানিয়েছে, জামাল গ্রেপ্তারের পর অন্তত ২০ মানব পাচারকারীর তালিকা তৈরি করে পুলিশ। কিন্তু সেটি তালিকা তৈরি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারী চক্রের অনেকেই সদর্পে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন তথ্য এলাকাবাসী জানালেও পুলিশ তা মানতে নারাজ। পুলিশের পক্ষ থেকে মানব পাচারকারীদের একটি তালিকা তৈরির কথা স্বীকার করা হলেও সেটি কয়জনের তা জানাতে পারেননি অষ্টগ্রাম থানার ওসি (তদন্ত) আবদুল জব্বার। তিনি জানান, ওসি কামরুল ইসলাম মোল্লা ছুটিতে রয়েছেন। তার কাছেই তালিকাটি রয়েছে। তবে তালিকাভুক্ত আর কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, এ বিষয়টি তিনি মানবজমিনকে বুধবার বিকালে নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, গ্রেপ্তারকৃত জামাল মিয়া আবদুল্লাহপুর উত্তরপাড়ার হেকমত আলী মইন্যার ছেলে। জামালের আরেক ভাই মফিজ মিয়া (৪০)-ও একই পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ ও এলাকাবাসী জানিয়েছে। তবে জামালকে গ্রেপ্তারের খবরে সে গা-ঢাকা দেয়। জামালকে গ্রেপ্তারের পরদিন ৩রা জুন তাকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ইন্সপেক্টর হুমায়ুন কবিরের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। এদিকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত জামাল মিয়া জামিনে বেরিয়ে এসেছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। জামালের জামিনে মুক্তির খবরে স্থানীয় পাচারচক্রের লোকজন ফের প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এলাকাবাসী জানায়, জামালের বাবা হেকমত আলী মইন্যা এলাকায় কাঁচামাল ও মাছের ব্যবসা করতেন। পরিবারের আর্থিক অনটন ঘোচাতে আট ভাইয়ের মধ্যে ৫ম জামাল ৪/৫ বছর আগে মালয়েশিয়া পাড়ি জমায়। মালয়েশিয়ায় গিয়ে সেখানকার মানব পাচার চক্রের সঙ্গে সে যুক্ত হয়ে পড়ে। পরে নিজ এলাকা আবদুুল্লাহপুর ছাড়াও অষ্টগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন গ্রামসহ জেলার ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর ও মিঠামইন উপজেলায় বিশাল সহযোগীচক্র গড়ে তুলে। তার চক্রের সদস্যসংখ্যা অন্তত শতাধিক হবে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। দেশে থেকে জামালের ভাই মফিজ চক্রের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছিল। জামালের নিজ গ্রাম আবদুুল্লাহপুরেই চক্রের অন্তত ১৫ সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রামের হাসান আলীর ছেলে পলাশ (২৫), আমির উদ্দিন সরকারের ছেলে ইকবাল (৪৫), মৃত কাল্লু মিয়ার ছেলে কুদ্দুছ (৪৫), তৈয়ব আলীর ছেলে হারিছ (৩৫), কামাল পাশার ছেলে পলাশ (৩৫), আক্কাছ আলী ইজলু মেম্বারের ছেলে জয়নাল (৪০), সুরুজ মিয়ার ছেলে খালেক (৩৫) ও মঞ্জুর আলীর ছেলে মাঈন উদ্দিন (৩৫) নাম জানা গেছে। এছাড়া আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের কলিমপুর গ্রামের ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য হারুন মেম্বার এই চক্রের অন্যতম সক্রিয় সদস্য। এসব চক্রের লোকজন নিজেদের এলাকার নিরীহ লোকদের মালয়েশিয়ায় ভাল চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের সমুদ্রপথে পাচার করে। এই চক্রের প্রলোভনে পড়ে এসব এলাকার অন্তত ৫ শতাধিক মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই নিখোঁজ আবার অনেকেই প্রতিবেশী দেশ নেপালসহ বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। গত বছরের নভেম্বরে মানব পাচারের অভিযোগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানায় নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাহবুবুর রহমান বাদী হয়ে দায়ের করা ওই মামলায় ২৩ মানব পাচারকারীকে আসামি করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, মালয়েশিয়া প্রবাসী আবদুল্লাহপুরের জামাল মিয়া ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। জামাল গ্রেপ্তার হওয়ার সময় পতেঙ্গা থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানিয়েছিলেন, মানব পাচার আইনে দায়ের করা ওই মামলাটি শুরুতে তিনি তদন্ত করেছিলেন। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। মাস তিনেক আগে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকার সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম শাখার পরিদর্শক হুমায়ুন কবির বর্তমানে মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
পুলিশ জানায়, মানব পাচার চক্রের অন্যতম সক্রিয় সদস্য জামাল। সে মালয়েশিয়ায় বসে তার স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণ করতো। এছাড়া সে অবাধে যখন-খুশি দেশে আসা-যাওয়া করে বিদেশ নেয়ার নাম করে মানব পাচার করে আসছিল। এছাড়া মুক্তিপণ আদায়সহ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে আরো টাকা আদায়ে নানাভাবে নির্যাতনে সে ভূমিকা রাখতো। মানব পাচারের নামে নানা অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই শুরু হলে সম্প্রতি জামাল মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসে। এ অবস্থায় পতেঙ্গা থানায় মানব পাচারের মামলায় অভিযুক্ত জামাল মিয়াকে ধরতে অভিযানে নামে পুলিশ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ২রা জুন দুপুরে অষ্টগ্রাম থানার ওসি কামরুল ইসলাম মোল্লার নেতৃত্বে পুলিশ আবদুল্লাহপুর বাজারে অভিযান চালায়। অভিযানের সময় বাজারের একটি দোকান থেকে জামালকে আটক করা হয়। আবদুল্লাহপুর ইউপির ৬নং ওয়ার্ড সদস্য আবদুল্লাহপুর উত্তরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা মেম্বার বলেন, ৪/৫ মাস আগেও তার গ্রামের বেশকিছু যুবক সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জামাল চক্রের লোকজনকে কেউ দুই লাখ, কেউ সোয়া দুই লাখ আবার কেউ আড়াই-তিন লাখ টাকা দেয়। এদের মধ্যে আবদুল্লাহপুর, কদমচাল, কলিমপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের অন্তত ১০ জন যুবকের কোন খোঁজ এই ৪/৫ মাসেও মিলেনি। দালালচক্রের লোকজনের এই প্রতারণার কারণে গ্রামে গ্রামে কান্নার রোল পড়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.