জোড়া খুন: বখতিয়ারের সঙ্গে গাড়িতেই ছিলেন কামাল, সাংসদপুত্র হওয়ায় সুবিধা নিচ্ছেন বখতিয়ার

ইস্কাটনে জোড়া খুনের সময় সাংসদপুত্র বখতিয়ার আলম রনির সঙ্গে গাড়িতেই ছিলেন বন্ধু কামাল মাহমুদ। এরপর তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়। আজ বুধবার মহানগর হাকিম আমিনুল হকের খাস কামরায় জবানবন্দি দেন তিনি। সেখানেই তিনি এ কথা জানান বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। এদিকে এ ঘটনায় ব্যবহৃত প্রাডো গাড়িটি জিম্মায় নিতে আবেদন করা হয়েছে। বখতিয়ারের মা সরকারদলীয় সাংসদ পিনু খানের পক্ষে তানভীর আহমেদ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আজ আবেদনটি করেন। আদালত পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে গাড়ির মালিকানা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। গত রোববার গাড়িটি জব্দ করে গোয়েন্দা পুলিশ।
গত ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে নিউ ইস্কাটনে ওই গাড়ি থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে রিকশাচালক ও জনকণ্ঠ পত্রিকার অটোরিকশাচালককে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় বখতিয়ারের গাড়ির পেছনের আসনে ছিলেন কামালসহ দুই বন্ধু। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ বখতিয়ার ও তাঁর গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে গ্রেপ্তার করে।
আজ দুপুর তিনটার দিকে কামালকে আদালতে নিয়ে আসেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এরপর তিনি বিচারকের সামনে জবানবন্দি দেন। আদালত সূত্র আরও জানায়, কামাল বলেছেন, বখতিয়ার ও তিনি বন্ধু। ঘটনার দিন তাঁরা ওই গাড়িতে (জব্দ) করে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
বখতিয়ারকে দায়ী করে গাড়িচালক ইমরান ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইস্কাটনে যানজটে আটকা পড়ে নেশাগ্রস্ত বখতিয়ার লাইসেন্স করা পিস্তল বের করে গাড়ির জানালা দিয়ে এলোপাতাড়ি চার-পাঁচটি গুলি ছোড়েন।
বখতিয়ার তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেন, ওই রাতে তাঁরা প্রথমে বাংলামোটরের একটি বারে যান। এরপর হোটেল সোনারগাঁওয়ে যান। সেখান থেকে বখতিয়ার তাঁর গাড়িতে করে মগবাজারে নামিয়ে দেন জাহাঙ্গীরকে। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে বাংলামোটর হয়ে হাতিরপুলে যান। নিউ ইস্কাটনে রাত পৌনে দুইটায় যানজটে পড়লে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। তখন তিনি চালকের পাশের আসনে বসে ছিলেন। আর পেছনের আসনে ছিলেন কামালসহ দুই বন্ধু। এরপর হাতিরপুলের বাসার সামনে কামালকে এবং অন্যজনকে আরেক স্থানে নামিয়ে ধানমন্ডির বাসায় ফেরেন তিনি।
সাংসদপুত্রের পিস্তলের লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করবে ডিবি
সাংসদপুত্র বখতিয়ার আলম রনির পিস্তলের লাইসেন্স বাতিল করার আবেদন করবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এই পিস্তলের গুলিতে অটোরিকশাচালক ও রিকশাচালক নিহত হওয়ার পর ৪ জুন পুলিশ পিস্তলটি জব্দ করে। পরীক্ষার জন্য এটি সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। এদিকে বখতিয়ারের জামিন আবেদন গতকাল নাকচ করে দিয়েছেন আদালত।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) দীপক কুমার দাস গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, পিস্তলের ব্যালাস্টিক প্রতিবেদন ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ঠিকানা যাচাই প্রতিবেদন পাওয়ার পর লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বখতিয়ারের লাইসেন্স করা কালো-সিলভার রঙের বিদেশি পিস্তলের গুলিতে জোড়া খুন হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে পিস্তলটি পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া অস্ত্রের লাইসেন্সের ঠিকানা জানতে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
জামিন আবেদন নাকচ: ঢাকা মহানগর হাকিম আমিনুল হক গতকাল শুনানি শেষে বখতিয়ারের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।
বখতিয়ার আলমের আইনজীবী শওকত ওসমান আদালতকে বলেন, আসামির নাম এজাহারে নেই। তাঁকে অহেতুক হয়রানির জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার দিন বখতিয়ার আলম তাঁর সন্তান ও মাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন। ওই দিন তিনি রাস্তায় বের হননি। এ ছাড়া যে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তা পরিকল্পিত ছিল না। আসামি গুরুতর অসুস্থ, তাঁর মা একজন সাংসদ; তাই জামিন দিলে তাঁর পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে বখতিয়ার আলমের পক্ষে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চান।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এর বিরোধিতা করে আদালতকে বলেন, এই মামলার আসামি ইমরান ফকির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বখতিয়ারের নাম বলেছেন। জব্দ হওয়া প্রাডো গাড়ি থেকে বখতিয়ার গুলি ছোড়েন। সেই গুলিতে রিকশাচালক আবদুল হাকিম ও জনকণ্ঠ-এর অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর ব্যবহৃত পিস্তল ও গুলি জব্দ করা হয়েছে। তাই জামিন দিলে তদন্তে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। এরপর শুনানি শেষে আদালত বখতিয়ার আলমের জামিন আবেদন নাকচ করে দেন।
বখতিয়ারের মা সরকারি দলের সাংসদ পিনু খান গত সোমবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। সেখানে তিনি এক কর্মকর্তার দপ্তরে বসে পৌনে এক ঘণ্টা কথা বলেন। বখতিয়ার কারা হাসপাতালে আছেন। একজন কারা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বখতিয়ার সুস্থ আছেন। চিকিৎসক তাঁর শরীরে কোনো রোগ পাননি।
গত ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে গাড়ি থেকে গুলি ছুড়লে রিকশাচালক হাকিম ও অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী আহত হন। হাকিম ১৫ এপ্রিল ও ইয়াকুব আলী ২৩ এপ্রিল মারা যান। ডিবি পুলিশ তদন্তে হত্যার ঘটনায় বখতিয়ার ও তাঁর গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে শনাক্ত করে। বখতিয়ার ও তাঁর গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে গ্রেপ্তার করা হয় গত ৩১ মে।
সাংসদপুত্র হওয়ায় সুবিধা নিচ্ছেন বখতিয়ার
জোড়া খুন মামলার আসামি বখতিয়ার আলম রনি সাংসদপুত্র হওয়ায় বিশেষ সুবিধা নিচ্ছেন। জিজ্ঞাসাবাদে খুনের কথা স্বীকার করলেও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি তিনি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেকোনো খুনের ঘটনায় আসামিদের দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং জবানবন্দি দেওয়ার জন্য নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু বখতিয়ারের ক্ষেত্রে কোনো চাপ ছিল না। শনিবার তাঁকে আদালতে নেওয়া হলেও আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়নি। অসুস্থতার ভান করলেও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
তবে তদন্ত কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) দীপক কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, বখতিয়ারকে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। এ মামলা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বখতিয়ারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির দরকার হবে না।
গত শনিবার চার দিনের রিমান্ড শেষে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বখতিয়ারকে আদালতে পাঠায়। ওই দিন বখতিয়ারকে ‘অসুস্থ’ উল্লেখ করে সাংসদ মায়ের জিম্মায় জামিনের আবেদন করেন তাঁর আইনজীবী শওকত ওসমান। ১৬ জুন তাঁর জামিনের আবেদনের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
গত ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে নিউ ইস্কাটনে রিকশাচালক ও জনকণ্ঠ পত্রিকার অটোরিকশাচালককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ বখতিয়ার ও তাঁর গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে গ্রেপ্তার করে। ১ জুন বখতিয়ারকে দায়ী করে গাড়িচালক ইমরান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি বলেন, তাঁরা নিউ ইস্কাটনে যানজটে আটকা পড়েন। এ সময় বখতিয়ার হঠাৎ লাইসেন্স করা পিস্তল বের করে গাড়ির জানালা দিয়ে চার-পাঁচটি এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। বখতিয়ার ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে পিস্তল দিয়ে গুলি করে দুজনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তখন তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন বলেও জানান।
পিস্তলটি জব্দ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি।
বখতিয়ারের মা সরকারদলীয় সাংসদ পিনু খান মহিলা আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক। এ জন্য ছাড় দেওয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলা তদন্তে কারও মাতৃপরিচয় বা পিতৃপরিচয় কিংবা সামাজিক পরিচয় পুলিশের কাছে বিবেচ্য নয়। অন্য পাঁচটা খুনির মতোই বখতিয়ারের ঘটনা দেখা হচ্ছে। মামলাকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো মহল থেকে পুলিশের ওপর চাপ নেই বলে দাবি করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.