জ্যামে বিরক্ত হয়েই গুলি চালিয়েছিল এমপিপুত্র -আদালতে রনির বন্ধু কামাল

‘বার থেকে বেরিয়ে আমরা সোনারগাঁও হোটেলে যাই। সেখান থেকে ইস্কাটন রোড দিয়ে মগবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। রনি চালকের পাশের আসনের পাশে বসা। আমরা তিনজন ছিলাম পেছনের সিটে। ফ্লাইওভারের কাজ হওয়ার কারণে ইস্কাটনের রাস্তা কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। হঠৎ যানজটে আটকে যায় গাড়ি। কয়েক মিনিট পরই হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে উঠি। দেখি সামনের সিট থেকে আচমকা গুলি করছে রনি। আমি তাকে বলি ‘এই তুমি এইটা কি করলা? রনি কিছু বলে না। একটু হাসে। যানজট ভেঙে গেলে গাড়ি মগবাজারে পৌঁছে যায়। সেখানে জাহাঙ্গীর নেমে যায় গাড়ি থেকে। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার বাংলামোটরের দিকে চলতে থাকে। রনি ড্রাইভারকে দ্রুত যেতে বলে। আমি তখনও জানতাম না রনির গুলিতে কেউ মারা গেছে কি না। পরদিন পত্রিকা পড়ে জানতে পারি। পরে ভয়ে এনিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য করিনি।’
রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডে জোড়া খুনের ঘটনায় এমপিপুত্র বখতিয়ার আলম রনির বিরুদ্ধে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এমন বর্ণনা দিয়েছেন তার বন্ধু কামাল মাহমুদ। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই দীপক কুমার তাকে আদালতে হাজির করলে সাক্ষী হিসেবে তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আমিনুল হক তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন। জবানবন্দিতে কামাল ঘটনার পূর্বাপর বর্ণনা দেন। তিনিও বলেন, যানজটে বিরক্ত হয়ে রনি নিজের লাইসেন্সকৃত পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি ৪-৫ রাউন্ড গুলি করে।
গত ১৩ই এপ্রিল মধ্যরাতে নিউ ইস্কাটনে মদ্যপ অবস্থায় রনি তার লাইসেন্সকৃত পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়লে এক রিকশাচালক ও জনকণ্ঠ পত্রিকার অটোরিকশাচালক নিহত হন। গোয়েন্দা পুলিশ প্রযুক্তি ও সিসিটিভির ফুটেজ দেখে গাড়িটি শনাক্ত করে। পরে প্রথমে গাড়িচালক ইমরান ফকির ও পরে গুলি বর্ষণকারী এমপিপুত্র রনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইমরান ফকির আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও রনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিলে তিনি অসুস্থতার ভান করেন। পরে তাকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রনি যানজটে বিরক্ত হয়ে গুলি চালানোর কথা স্বীকার করেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার সময় বখতিয়ারের গাড়ির পেছনের আসনে কামালসহ আরও দুই বন্ধু ছিলেন। পুলিশ তাদের মধ্যে গতকাল কামালকে আটক করে। কামাল সাক্ষী হিসেবে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হলে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। কামাল তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, ঘটনার রাতে তারা একসঙ্গে দীর্ঘ সময় ছিলেন। প্রায়ই তারা একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। কিন্তু রনির কাছে যে লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল সেটা জানতাম না। বেশ কয়েকদিন ধরে ওর কন্যাসন্তান এ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে ছিল। পরিবারের সদস্যরাই তার দেখাশোনা করতো। ঘটনার দিন আমরা বাংলামোটরের শ্যালে নামে একটি বারে যাই। সেখান থেকে হোটেল সোনারগাঁওয়ের লবিতে বসে আড্ডা দেই। রাত দেড়টার দিকে আমরা রনির গাড়িতে করে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হই। রনির মায়ের এই প্রাডো গাড়িটি রনিই বেশির ভাগ সময় ব্যবহার করতো। আমরা সোনারগাঁও হোটেল থেকে বেরিয়ে জাহাঙ্গীরকে নামানোর জন্য মগবাজারের দিকে যেতে থাকি। জনকণ্ঠ কার্যালয়ের সামনে রনি তার পিস্তল বের করে গুলি করে। পরদিন পত্রিকায় দু’জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দেখে আমি বিস্মিত হই। এরপর কিছুদিন আমি রনিকে এড়িয়ে চলি। রনি মাঝেমধ্যে কিছুটা বেপরোয়া চলাফেরা করতো। ওর এসব আচরণ আমরাও সমর্থন করতাম না। ও মনে করতো ওর মা যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের এমপি, ওর কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে ধরা খেতে হলো।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঘটনার সময় বখতিয়ার যে গাড়িতে ছিলেন, সেই গাড়িটি গত রোববার বিকালে জব্দ করা হয়েছে। এটি তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি পিনু খানের গাড়ি। পুলিশের পক্ষ থেকে তার পিস্তলের লাইসেন্স বাতিলের আবেদনের পাশাপাশি সেটি জব্দ করে ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, রনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলেও বস্তুগত প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। পিস্তলটি ব্যালাস্টিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট আসলে বিষয়টি শতভাগ নিশ্চত হয়ে যাবে। আগামী দুই-একদিনের মাথায় পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়া যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.