‘লন লন, এক্কেরে মধুর মতো মিষ্টি...’ by মোছাব্বের হোসেন

লিচুর লালিমায় লোভনীয় হাতছানি। প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে রসে ভরা এই ফল নিয়ে হেঁকে যাচ্ছিলেন আমিনুল মিয়া, ‘লন লন, এক্কেরে মধুর মতো মিষ্টি! খাইয়া লন, মিষ্টি না হইলে টেকা ফিরত।’
গতকাল সোমবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে এভাবেই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে দেখা যায় আমিনুলকে (৪০)। জানালেন, এই লিচু পাবনার ঈশ্বরদী থেকে এসেছে। আকারে মাঝারি ও গায়ে লালটা একটু গাঢ়। প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি করছেন ৩০০-৩৫০ টাকায়। তাঁর মতো আরও অনেকে এখানে রাস্তার পাশে লিচুর দোকান দিয়েছেন।
রাজধানীর স্থায়ী ফলের দোকান তো বটেই, রাস্তার পাশেও অনেকে বসে গেছেন লিচুর পসরা নিয়ে। সচিবালয়, বড় বড় বিপণিকেন্দ্র, ফুটপাত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনে, সদরঘাট, রেলস্টেশন ও বাস টার্মিনালগুলোতে এখন বিক্রি হচ্ছে নানান জাতের লিচু। দেখতে আকর্ষণীয় বলে এই ফল সহজে মানুষের নজর কাড়ে। আর স্বাদটাও এমন যে জিভের জল সামলানো দায়।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মৌসুমি ফলের মতো তাঁদের অনেকেই মৌসুমি বিক্রেতা। কয়েকজন লিচু বিক্রেতার তথ্যমতে, অন্যান্য বারের মতো এই মৌসুমে প্রথম লিচু আসে চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে। শুরুতে লিচু আসছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে। কারণ সারা দেশের মধ্যে সেখানের লিচুই আগে পাকে। আকারে ছোট লাল রঙের এই লিচু প্রধানত রাজধানীর বাজারে বিক্রি হয় বেশি।
কারওয়ান বাজারের লিচু বিক্রেতা জাহাঙ্গীর মিয়া ঈশ্বরদীর ১০০টি লিচু ৩০০ ও দিনাজপুরের লিচু ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করছিলেন। তাঁর তথ্যমতে, সোনারগাঁয়ের পরপর ঈশ্বরদী ও রাজশাহীর লিচু বাজারে আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ, মেহেরপুরের লিচুও চলে আসে। তবে সবার শেষে আসবে দিনাজপুরের লিচু। তিনি বলেন, ‘লিচু এমনই এক ফল, মানুষ দ্যাখলেই কেনে। নিজেরা খায়, আবার অন্য মানুষেরে খাওয়ায়, গিফট দেয়।’
লিচু দেখে লোভ সামলানো দায়। ছবিটি রাজধানীর পুরানা
পল্টন এলাকা থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা
মতিঝিলের দৈনিক বাংলা মোড়ের বিক্রেতা আলম মিয়ার ভাষ্য, ‘এইডা অল্প সময়ের ফল। লিচু দ্যাখতে দ্যাখতেই ফুরায় যায়। এই দ্যাখবেন আছে, এই নাই।’
বিক্রেতাদের ভাষ্য, দিনাজপুরের লিচুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আকারেও এই জেলার লিচু বড়। বীজ ছোট ও বড় আঁশের এই লিচুর নাম সারা দেশে। অনেকে দিনাজপুরের বেদানা লিচুর নাম করেন। রসিকতা করে বলেন, ‘টাকা দিয়েও যেখানে মন গলে না, সেখানে মানুষ এই জাতের লিচু উপহার বা উপঢৌকন নিয়ে যান। ব্যস, কাজ হয়ে যায়।’
লিচু কিনতে গিয়ে ক্রেতার হয়রানিতে পড়ার দৃশ্যও গতকাল চোখে পড়েছে। দুপুরে গুলিস্তানে এক তরুণী লিচুর দোকানের সামনে যেতেই বিক্রেতা লিচুর থোকা থেকে লিচু ছিঁড়ে দিলেন তাঁর হাতে। তিনি দাম জানতে চাইতে না চাইতেই আবার সেই লিচুর চামড়াও তুলে তাঁকে চেখে দেখতে বললেন। তরুণী সেটি না খেয়ে দাম শুনে চলে যেতে চাইলে বিক্রেতা কটু কথা বলতে শুরু করলেন। তরুণী রেগে গিয়ে বলেই ফেললেন, ‘আপনাকে লিচু ছিঁড়তে বলছিল কেউ?
হাতিরপুল থেকে লিচু কিনছিলেন ধানমন্ডির বাসিন্দা আখতার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। খাবার শেষে ফল হিসেবে লিচু পরিবেশন করা হবে। এ ছাড়া আমাদের বাড়িতেও সবাই লিচু খুব পছন্দ করে।’
লিচু বিক্রেতারা জানান, আরও ১৫-২০ দিন লিচুর সরবরাহ থাকবে বেশি। এরপর আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। সেই হিসেবে বলা যায়, আরও ২০-২৫ দিন লিচুর দেখা মিলবে রাজধানীর বাজারগুলোতে।
লিচুর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা আখতারুন নাহার বলেন, ‘লিচু খুব বেশি দিন থাকে না। অল্প দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। লিচুতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুর মধ্যে ৬১ ক্যালরি। এ ছাড়া শর্করা ১৩ দশমিক ৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৩১ মিলিগ্রাম থাকে। তিনি বেলন, লিচু একদম ছোট বাচ্চাকে খাওয়ানো ঠিক নয়। তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশু এটি না খেলেই ভালো। কেননা লিচু সহজে হজম হয় না। এটি বেশি খেলে বড়দেরও বদহজম হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.