মালয়েশিয়ায় ১৩৯ গণকবর

মালয়েশিয়া পুলিশ কয়েকটি স্থানে প্রায় দেড় শ’ গণকবরের সন্ধান পেয়েছে। একই সঙ্গে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৮টি বন্দিশিবির। তবে তা পরিত্যক্ত। পুলিশ ধারণা করছে, সেখানে শ’ শ’ মানুষকে আটকে রাখা হয়েছিল। এসব গণকবরে কোন দেশের নাগরিককে সমাহিত করা হয়েছে তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে বহু বাংলাদেশীর লাশ থাকতে পারে। এর মধ্য  দিয়ে মানব পাচারের যে চিত্র ফুটে উঠলো তা থাইল্যান্ডের কাহিনীকেও হার মানায়। থাইল্যান্ডের গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল ২৬টি মৃতদেহ। কিন্তু মালয়েশিয়ায় শনাক্ত করা হয়েছে ১৩৯টি গণকবর। ধারণা করা যায়, এতে সমাহিত করা হয়েছে গণকবরের সংখ্যার কয়েক গুণ লাশ। গতকাল এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পর চারদিকে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, সম্প্রতি বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পাচারের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা মিডিয়া প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় এসব গণকবরে বহু বাংলাদেশীর লাশ থাকার আশঙ্কাই বেশি। হয়তো বন্দিশিবিরগুলোতে তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছিল। গতকাল ব্যাংকক পোস্ট বার্তা সংস্থা এএফপির একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ওই সব গণকবর থাইল্যান্ডের সীমান্তের কাছাকাছি। ফলে ধরে নেয়া যায় যে, ওই সব মানুষকে সেখানে বন্দিশিবিরগুলোতে আটকে রাখা হতো। মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান খালিদ বিন আবু বকর বলেছেন, ওই সব গণকবরে থাকা লাশগুলোর অবশিষ্ট উদ্ধারে কাজ করছে পুলিশ। তবে এতে কি পরিমাণ মৃতদেহ আছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তিনি বলেন, থাই সীমান্তের কাছে পাহাড়ি জঙ্গলে শনাক্ত করা হয়েছে গণকবর ও বন্দিশিবিরগুলো। এসব এলাকা দুর্গম এলাকায়। এ মাসের শুরুর দিকে থাইল্যান্ড তার দক্ষিণ সীমান্তে একই রকম গণকবর উদ্ধারের পর মানব পাচার নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। ওদিকে সমুদ্রে ভাসমান অভিবাসীদের পরিণতি কি হয়েছে তা এখনও আর কেউ বলতে পারছে না। গত সপ্তাহের বুধবার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কুয়ালালামপুরে এ ইস্যুতে জরুরি বৈঠক করেন। তার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া শর্তসাপেক্ষে সমুদ্রে ভাসমান অভিবাসীদের উদ্ধারে সম্মত হয়। এরই মধ্যে তাদেরকে উদ্ধারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপর কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরও বড় ধরনের কোন উদ্ধারের খবর শোনা যায় নি। ফলে সমুদ্রের ভিতর অবর্ণনীয় অবস্থায় বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের যেসব রোহিঙ্গা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন তাদের শেষ পরিণতি কি হয়েছে বা তারা কেমন আছেন সে বিষয়ে কোন খবর মিলছে না। কেউ বলতে পারছেন না, তারা এখন সাগরের কোথায়, কোন অঞ্চলে আছেন। ওদিকে গতকাল থাই পুলিশ বলেছে, থাইল্যান্ডের দক্ষিণে আর কোন মানব পাচারের ক্যাম্প নেই। এ মাসের দমনপীড়নের ফলে এসব ক্যাম্পের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু মালয়েশিয়ায় মানব পাচার নিয়ে দীর্ঘদিন মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো মালয়েশিয়ার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে চেষ্টা করেছে। জবাবে মালয়েশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তারা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু গতকাল যে বিপুল পরিমাণ গণকবরের সন্ধান মিলেছে তাতে মালয়েশিয়াকে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশের একটি বলে অভিহিত করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের কন্যা মেরিনা মাহাথির। থাই সীমান্তের ওয়াং কেলিয়ান শহরের কাছে গতকাল পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল খালিদ সাংবাদিকদের কাছে বলেন, তারা ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান পেয়েছেন। তবে এসব গণকবরের প্রতিটিতে কতটি লাশ রাখা হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন নি তিনি। জেনারেল খালিদ বলেন, তারা ২৮টি পরিত্যক্ত বন্দিশিবিরের সন্ধান পেয়েছেন। কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ খুঁজছে। এরপর সেগুলোর ময়না তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, উদ্ধার করা লাশের মধ্যে একটি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বন্দিশিবিরে মারা যাওয়া অভিবাসীদের সমাহিত করা হয়েছে এসব গণকবরে। তবে কি কারণে ওই সব অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে পুলিশ নিশ্চিত করে তার কারণ জানাতে পারেনি। তবে বন্দিশিবির ও তার সংখ্যা দেখে বোঝা যায়, সেখানে অবস্থান করতেন কয়েক শত অভিবাসী। জেনারেল খালিদ বলেন, সবচেয়ে বড় যে বন্দিশিবির তাতে ধারণক্ষমতা ৩০০ মানুষের। আরেকটিতে ১০০ মানুষ থাকতে পারে। বাকিগুলোর প্রতিটিতে ২০ জন করে মানুষ থাকার মতো স্থান আছে। এসব গণকবর ও বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়ার পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বলেছেন, জঙ্গলে যেসব গণকবর ও বন্দিশিবির পাওয়া গেছে গভীর উদ্বেগের বিষয়। তিনি ফেসবুক পেজে বলেছেন, আমরা এর জন্য দায়ী সবাইকে খুঁজে বের করব। উল্লেখ্য, এ মাসের শুরুতে মালয়েশিয়াতে এমন পাচারকারী নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, মালয়েশিয়া কখনও মানুষ পাচারকে সহ্য করবে না। কিন্তু তার কয়েক দিনের মধ্যে এমন গণকবর ও বন্দিশিবির পাওয়া যাওয়ায় সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন  মালয়েশিয়ার শ্রম ও অভিবাসীর অধিকার বিষয়ক গ্রুপ তেনাগানিতার এজিলি ফার্নান্দেজ। তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত সরকার জানে সীমান্তে এসব অপরাধের কথা। এসব অপরাধী কারা তারা তাও জানে। এর দায় নিতে হবে শীর্ষ পদকেও। আমি নিশ্চিত, পুলিশ জানে অপরাধী সিন্ডিকেটে কারা আছে। এসব বন্ধ করতে প্রয়োজন শুধু তাদের ইচ্ছাশক্তি। পাচারবিরোধী গ্রুপগুলো বলছে, ওয়াং কেলিয়ানের কাছে সীমান্ত এলাকা হলো মানব পাচারের একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। এ পথেই বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া ও অন্যান্য স্থানে পাচার করা হয়। কর্তৃপক্ষের অগোচরে কিভাবে মালয়েশিয়াতে এতগুলো বন্দিশিবির গড়ে উঠল- এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান মালয়েশিয়ার পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল খালিদ।
লাশ উত্তোলন করে শনাক্ত করা হবে: রোববার পেডাং বেসারে যেসব গণকবর আবিষ্কার করা হয় সেখান থেকে গতকালও মৃতদেহ উত্তোলনের কাজ চলছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আহমেদ জাহিদ হামিদি বলেছেন, রোববার সন্ধান পাওয়া গণকবরের অবশিষ্টাংশ উত্তোলন করে পাঠানো হচ্ছে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য। এতে চিহ্নিত করা যাবে যে, কতজনকে এক একটি গণকবরে সমাহিত করা হয়েছে। ফরেনসিক ইউনিটের যে টিমটি এ কাজ করছে তারা একই কাজ করতে ইউক্রেন গিয়েছিল। ফলে তাদের এ কাজে রয়েছে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে থাই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। মত বিনিময়ও হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে মালয়েশিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা বারনামা। ওদিকে মালয়েশিয়ার অনলাইন দ্য স্টার পত্রিকা বলেছে, পেনাংয়ে উদ্ধার করা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হবে সরকারি আবাসন ব্যবস্থায়। তিনি বলেন, এ জন্য ব্যবহার করা হবে কেন্দ্রীয় সরকারের আবাসন বিষয়ক স্থাপনা ও সরকারি প্রতিষ্ঠান।
জাপানের সহায়তা চাইল মালয়েশিয়া: বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অভিবাসী, যারা ভাসমান মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তাদের সমস্যা সমাধানে জাপানের কাছে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে মালয়েশিয়া। গত রাতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক এ আহ্বান জানান। নাজিব রাজাক এখন তিন দিনের জাপান সফরে রয়েছেন। তিনি বলেন, এ সমস্যা এখন আর শুধু আসিয়ানের নয়। এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপ। 
আশ্রিত বাংলাদেশীদের শিগগিরই ফেরত পাঠাবে ইন্দোনেশিয়া: আশ্রিত বাংলাদেশীদের শিগগিরই ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করবে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির একজন মন্ত্রী এ কথা জানিয়েছেন। আচেহ প্রদেশে ৭০০ বাংলাদেশী অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। আন্দামান সমুদ্রে তাদের বহনকারী নৌকা পাচারকারীরা ফেলে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক চাপে তাদের উদ্ধার করে ইন্দোনেশিয়া। এ খবর দিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। আচেহ প্রদেশে এক সফরে ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক সমপর্ক মন্ত্রী খোফিফাহ ইন্দার পারাওয়ানসা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তার সরকার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে। খুব শিগগিরই বাংলাদেশীদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করা হবে। আগামী ৩-১০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশীরা ট্রাভেল ডকুমেন্ট পেয়ে যাবে। এরপর উত্তর সুমাত্রা প্রদেশের রাজধানী মেদান থেকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। ট্রাভেল ডকুমেন্ট প্রস্তুত হবার ২-৩ মাসের মধ্যেই তাদের বিমান টিকিট হাতে পাওয়া যাবে বলে জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশীদের ভ্রমণের সমস্ত খরচ আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইওএম) বহন করবে।

No comments

Powered by Blogger.