আসুন, আমরা লজ্জিত হই! by কামাল আহমেদ

কোথাও আশ্রয় পাচ্ছে না সাগরে ভাসা মানুষ। নারী, পুরুষ, শিশু
সবাই সেখানে গাদাগাদি করে কোনো রকমে বেঁচে আছেন
সপ্তাহ দু-এক ধরে সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে ছাপা হয়েছে সাগরের বুকে করুণভাবে পরিত্যক্ত হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর অসহায় আহাজারির মর্মস্পর্শী বিবরণ। রেডিও-টেলিভিশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই মানবিক দুর্ভোগের বিষয় নিয়ে প্রচারিত হয়েছে নানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত বুধবার বিভিন্ন দেশ তাদের প্রতি কিছুটা সদয় হওয়ার কথা ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। তার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন খবর, নিবন্ধ ও আলোচনায় সবার প্রধান চেষ্টা ছিল বিপন্ন নৌযানগুলোকে তীরে ভিড়তে না দেওয়া কতটা নিষ্ঠুর, সেটিই তুলে ধরা। অবশ্য ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের আচরণে নিষ্ঠুরতার চিত্র তুলে ধরার বিপরীতে এসবে আমাদের আত্মসমালোচনার লেশমাত্র ছিল না।
মাত্র দুই বছর আগের কথা। ২০১২ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে যখন নতুন করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয় এবং তখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা ওই একই সমুদ্রের একটি প্রান্তে বিপজ্জনক নানা ধরনের নৌযানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের উপকূলে ভিড়তে চেয়েছিল। ওই সহিংসতায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বিবিসির হিসাবে দুই শতাধিক। তবে অন্যান্য হিসাবে আরও বেশি। সে সময় প্রায় সোয়া লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (‘অল ইউ ক্যান ডু ইজ প্রে’ শীর্ষক প্রতিবেদন, এপ্রিল ২২, ২০১৩)। তারপর ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে আরও কয়েক দফায় সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলে, যেসব ঘটনায় নিহত হয় আরও শ খানেক মানুষ (হোয়াই ইজ দেয়ার কমিউনাল ভায়োলেন্স, জুলাই ৩, ২০১৪, বিবিসি ওয়েবসাইট)। সেই ২০১২ সাল থেকেই আমাদের সরকার পলায়নপর রোহিঙ্গাদের নৌযানগুলো ফিরিয়ে দিতে থাকে। সে সময় কিন্তু আমাদের সংবাদমাধ্যমে বিপন্ন মানুষের প্রতি কোনো সহানুভূতির ছায়া পড়েনি। মিয়ানমারের আধা সামরিক জান্তার মদদে বৌদ্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো যখন সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে দেশছাড়া করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, সে সময় আমরা কতটা মানবিক আচরণ করেছি, সেই আত্মজিজ্ঞাসার কোনো লক্ষণ কিন্তু এখনো দৃশ্যমান নয়। রোহিঙ্গাদের নৌযান সাগরে ফিরিয়ে দেওয়ার নীতি এখনো বহাল আছে। এই নীতির পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি—এমনিতেই দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কমপক্ষে ২৩ হাজার আর ভিন্ন হিসাবে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বোঝা বইতে বইতে মানবিক হওয়ার ক্ষমতা আমাদের আর নেই।
মানবিক বিবেচনার সঙ্গে সামর্থ্যের হিসাব কোনো দিনও মেলে কি না, সেই বিতর্কে না জড়িয়েও যে বিষয়টিতে আমাদের নজর দেওয়া উচিত তা হলো আমরা প্রতিবেশীর বাড়িতে একের পর এক খুনের ঘটনায় চুপ থেকেছি, হইচই করে অন্যদের জড়ো করে তার বিরুদ্ধে কোনো জোরালো প্রতিবাদও করিনি। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপের অন্য দেশগুলো যদি তাদের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে পারে, তাহলে আমাদের ঝামেলা বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই বলেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কূটনৈতিক অঙ্গনে যে ধরনের ভূমিকা নিলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়ন হয়তো আরও আগেই বন্ধ করা সম্ভব হতো, সেটুকু থেকেও আমরা পিছিয়ে থেকেছি। এমনকি, ওই ২০১২ সালেই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় লালগালিচা সংবর্ধনার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে সেই পরিকল্পিত সফর বাতিল করেন। নিষ্ঠুর নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার নীতির জন্য যদি আমাদের কোনো আত্মপীড়া না হয়, তাহলে অন্যদের সমালোচনা কতটা যৌক্তিক? চলমান অভিবাসী সংকটের পটভূমিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সেই মিয়ানমারই এখন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হয়েছে।
আশ্রয়ের সন্ধান অথবা ভাগ্যান্বেষণ—যে কারণেই হোক না কেন অনিশ্চয়তাকে ভর করে যেসব নর-নারী বঙ্গোপসাগরের বুকে লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন—তাঁদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা, এমন কথা বলে আমাদের রাজনীতিক ও কর্তাব্যক্তিরা এখনো একধরনের সান্ত্বনা খোঁজেন। কথাটা স্থূল অর্থে ঠিক হলেও সূক্ষ্ম বিচারে যথার্থ নয়। জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা—শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএম এবং মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর ওএইচসিএইচআরের হিসাবমতে, এসব অভিবাসনকামীর মধ্যে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের অনুপাত প্রায় ৬০: ৪০। আবার এদের মধ্যে মালয়েশিয়ার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থানকারীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৬০ শতাংশের মতো। সুতরাং, মানব পাচারকারীদের হাতে হেনস্তা হওয়া এসব দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা এমন যুক্তি দেখিয়ে পার পাওয়ার অবকাশটা কই? এই মানবিক বিপর্যয়ের কবলে পড়া হতভাগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যাও তো কয়েক হাজার। আমাদের সরকারের দাবি অনুযায়ী শনৈঃশনৈঃ উন্নতির ছিটেফোঁটাও যদি এঁদের কাছে পৌঁছাত, তাহলে কি তাদের কপালে ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’র তকমা পড়ত?
কথিত অর্থনৈতিক অভিবাসন ঠেকাতে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ইতিমধ্যে আমাদের তিন দিকের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। আর যেটুকুতে এখনো বেড়া লাগানো শেষ হয়নি, সেই অংশগুলো পরিণত হয়েছে প্রাণঘাতী সীমান্তে। তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জয়গান তখন আরও বেসুরো মনে হয়, যখন থাইল্যান্ডের সংখলার আশ্রয়শিবিরে আটকে পড়া কেউ কেউ স্বীকার করে নেন যে তাঁরা নিজেদের রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন এই ভেবে যে হয়তো তাতে করে সে দেশে স্থায়ীভাবে আশ্রয় মিলবে। নিপীড়নের মুখে পলায়নপর যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের আমরা আমাদের কূলে ভিড়তে দিই না, আমরা আবার তাদের পরিচয় ব্যবহারে কুণ্ঠিত হই না এই আশায় যে তাতে হয়তো নতুন করে ভাগ্য গড়ার সুযোগ মিলবে। অবশ্য এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে তাঁদের সেই সুযোগসন্ধানী আচরণের জন্য তাঁরা যতটা দায়ী তার চেয়ে আমাদের সরকারি কর্তাদের দুর্নীতি কোনো অংশেই কম দায়ী নয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে রাজনীতিক ও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অনেকের অভিযোগ যে এরা ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা আমদানিতে জড়িত। এ ক্ষেত্রেও কথিত অপকর্মের দায় যতটা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর বর্তায়, তার চেয়ে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রশাসনের দায় কোনোভাবেই নয়। বিশেষত, স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার পাশা খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকেরা যখন তাঁদের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানোয় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তা ছাড়া বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রসারে রোহিঙ্গাদের প্রভাবের চেয়েও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ভূমিকা রাখার ইতিহাস হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকদের, যেটা অতীতেও ছিল এবং এখনো আছে।
বঙ্গোপসাগর বা আন্দামান সাগরে মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হতভাগ্য রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের চরম দুর্গতি হয়তো সীমিত আকারে সাময়িকভাবে লাঘব হবে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের এক বছর মেয়াদি সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণায় অন্তত সেটুকু আশাবাদ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ফিলিপাইন, গাম্বিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র (সীমিতসংখ্যক) রোহিঙ্গাকে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জন্য নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলকরণ অভিযান যদি বন্ধ না হয়, তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলো যদি তারা ফিরে না পায়, যদি তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি না মেলে এবং বাংলাদেশসহ নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা শরণার্থীদের মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফেরার ব্যবস্থা যদি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে জটিলতা আরও বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। ভিনদেশের সাগরপাড়ে ঠেলে দিলে যদি তাদের শেষ পর্যন্ত বিতাড়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে মিয়ানমারের উগ্রবাদী বৌদ্ধগোষ্ঠীগুলো এবং সেখানকার সরকার আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। আবার একইভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে মানব পাচারে লিপ্ত মাফিয়ারাও লোভী হয়ে উঠতে পারে। এমনকি, রোহিঙ্গা পরিচয় ব্যবহারে প্রলুব্ধ করাও অসম্ভব নয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরে ভাসমান অভিবাসীদের নিয়ে যখন এসব উদ্যোগ-আলোচনা চলছে, তখন কিন্তু আমরা ভুলতে বসেছি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া অভিবাসনকামীদের কথা। অথচ মাত্র গত মাসেই আমরা ইতালির কাছে ডুবতে থাকা নৌযান থেকে উদ্ধার হওয়া জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশি অর্থনৈতিক অভিবাসীদের কথা জেনেছি। ভূমধ্যসাগরের ওই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তাঁরা ইতিমধ্যেই প্রায় অর্ধেক দুনিয়া পার হয়েছেন। কেউ গেছেন তুরস্ক হয়ে, আবার কেউ গেছেন আফ্রিকার মরুভূমি বা জঙ্গল পেরিয়ে। ভয়ংকর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত লিবিয়া হয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টাও হয়েছে বলে শোনা যায় এবং সর্বসম্প্রতি লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের যাওয়ার ওপর দেশটি নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
মাঝদরিয়ায় পরিত্যক্ত লোকজন রোহিঙ্গা কিংবা রোহিঙ্গা নন, এই বিভাজন টানতে পারলে নানা অজুহাতে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকা দিতে রাজনীতিকদের হয়তো সুবিধা হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য বাড়ায় যে মানুষ দেশ ছাড়তে বেপরোয়া, সে কথা স্বীকার করলে তো রাজনীতি থাকে না। তাই রাজনীতিকদের কথা বাদ থাকাই ভালো। কিন্তু ওই বিপন্ন মানুষের নৌকাগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সময় নিশ্চুপ থাকার জন্য আমরাও কি একটু লজ্জিত হব না?
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.